মেক্সিকোর জাতীয় পরিচয়ের রঙে এক প্রদর্শনী
যুক্তরাষ্ট্রের মিনিয়াপোলিস ইনস্টিটিউট অব আর্টে আয়োজিত প্রদর্শনী ‘হোসে মারিয়া ভেলাসকো: এ ভিউ অব মেক্সিকো’ দর্শকদের সামনে তুলে ধরেছে উনিশ শতকের শেষভাগের এক শিল্প প্রতিভা—হোসে মারিয়া ভেলাসকোকে (১৮৪০–১৯১২)। মাত্র ২৪টি শিল্পকর্ম নিয়ে সাজানো এই ছোট প্রদর্শনীটি আকারে সীমিত হলেও বিষয়বস্তুর দিক থেকে গভীর। লন্ডনের ন্যাশনাল গ্যালারিতে প্রদর্শিত বৃহত্তর সংগ্রহ থেকে সংক্ষিপ্ত সংস্করণ হিসেবে এই প্রদর্শনী মেক্সিকোর সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয় নির্মাণে ভেলাসকোর ভূমিকার প্রতি শ্রদ্ধা জানায়।
শিল্পে জাতি নির্মাণ: ভেলাসকোর দৃষ্টিভঙ্গি
ভেলাসকো শুধু মনোরম প্রকৃতি আঁকেননি, তিনি আঁকেছেন একটি জাতির আত্মা। স্পেন থেকে ১৮২১ সালে স্বাধীনতা লাভের পর মেক্সিকো সাম্রাজ্য থেকে প্রজাতন্ত্রে রূপান্তরিত হয় ১৮২৪ সালে। সেই পরিবর্তনের দশকজুড়ে ছিল রাজনৈতিক অস্থিরতা, যুদ্ধ ও শিল্পায়নের সূচনা। বিজ্ঞান, ভূতত্ত্ব, প্রকৃতি ও ইতিহাসে সুপণ্ডিত ভেলাসকো তাঁর চিত্রকর্মে এসব জ্ঞান একত্র করে ফুটিয়ে তুলেছিলেন এক নতুন মেক্সিকোর চিত্র—যে দেশ প্রাচীন ঐতিহ্যের ওপর দাঁড়িয়ে আধুনিকতায় পা রাখছে।
আমেরিকার হাডসন রিভার স্কুলের শিল্পীদের মতোই তিনি প্রকৃতিকে ব্যবহার করেছিলেন জাতীয় গর্ব প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে। তবে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল ভিন্ন—তিনি নতুন দেশের ভবিষ্যৎ নয়, বরং প্রাচীন সভ্যতার উত্তরাধিকারকে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। তাঁর তুলি ঘোষণা করেছিল, “মেক্সিকোর সংস্কৃতি অনেক পুরোনো, বহু সভ্যতার উত্তরসূরি।”
‘দ্য ভ্যালি অব মেক্সিকো’: প্রকৃতি ও পরিচয়ের প্রতীক
প্রদর্শনীর প্রথম চিত্র ‘দ্য ভ্যালি অব মেক্সিকো ফ্রম দ্য হিল অব সান্তা ইসাবেল ’ (১৮৭৫) দর্শকদের স্বাগত জানায় এক অনন্য প্যানোরামিক দৃশ্য দিয়ে। নীল আকাশের নিচে দূর দিগন্তে মেক্সিকো সিটি, তারও ওপারে পাহাড়ে বৃষ্টি আর তুষারাবৃত আগ্নেয়গিরি—যেন দেশটিকে রক্ষা করছে। সামনের অংশে দেখা যায় এক আদিবাসী নারী, তাঁর সন্তান, এক কিশোর ও কিছু কুকুর—প্রকৃতির সাথে মানুষের শ্রম ও উপস্থিতির নিদর্শন।
পরের গ্যালারিতে একই দৃশ্যের আরেকটি সংস্করণ (১৮৭৭) ঝুলছে—কিন্তু এবার গরম, শুকনো, উষর প্রান্তর। এই সংস্করণটি ভেলাসকোর শ্রেষ্ঠকর্ম হিসেবে বিবেচিত, কারণ এখানে তিনি মেক্সিকোর ইতিহাসের তিনটি সময়কালকে একসাথে ফুটিয়ে তুলেছেন—
১. পটভূমিতে আধুনিক শহর, রাস্তা ও রেলপথসহ।
২. মাঝামাঝি অংশে গুয়াদালুপের মাতা মারিয়ার মন্দির, যা স্প্যানিশ শাসনামলে স্থানীয় ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে মিশে যায়।
৩. সামনের অংশে শিলার ছায়ায় উড়ন্ত ঈগল ও ক্যাকটাস—আজটেক পুরাণের প্রতীক, যা আজও মেক্সিকোর পতাকায় স্থান পেয়েছে।
অতীত ও আধুনিকতার সংযোগ
প্রদর্শনীতে ভেলাসকোর অন্যান্য কাজও তাঁর বিস্তৃত আগ্রহ প্রকাশ করে। ‘দ্য পিরামিডস অব দ্য সান অ্যান্ড দ্য মুন’ (১৮৭৮) চিত্রে তিনি প্রাচীন তেওতিহুয়াকানের পিরামিডগুলোর ওপর সূর্যের কিরণ ঝলমল করে তুলেছেন। আর ‘দ্য বাথস অব কিং নেজাহুয়ালকয়োটল’ (১৮৭৮) চিত্রে দেখিয়েছেন পঞ্চদশ শতকের উন্নত জলপ্রবাহ প্রকৌশল—যেখানে পাথরের ভেতর দিয়ে ঝরনাধারা বয়ে যাচ্ছে উদ্যানের দিকে।

‘কার্ডন, স্টেট অব ওয়াহাকা’ (১৮৮৭) ছবিতে এক বিশাল ক্যাকটাসের নিচে ছায়ায় বসে থাকা এক কৃষক, আর ‘রকস’ (১৮৯৪)-এ প্রাকৃতিক পাথরের প্রতিকৃতি—সবকিছুতেই প্রকৃতি ও মানুষের সহাবস্থানের কাব্যিক রূপ ফুটে উঠেছে।
শিল্পায়নের প্রভাব: এক সতর্ক ইঙ্গিত
ভেলাসকো তাঁর সময়ের বাস্তবতাও এড়িয়ে যাননি। ‘দ্য গোথার্ড অব সান অ্যাঞ্জেল’ (১৮৬১, ১৮৬৩) নামের দুটি চিত্রে দেখা যায়, প্রকৃতির মাঝখানে ধোঁয়া ছড়ানো এক কারখানা—শিল্পায়নের আগ্রাসন এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সংঘাতের ইঙ্গিত। দ্বিতীয় চিত্রে একটি রাখাল তার ছাগলগুলোকে বিপজ্জনক গিরিখাতের দিক থেকে সরিয়ে নিচ্ছে—যেখানে পানির প্রবাহ বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী কলকারখানাকে চালায়। এতে বোঝা যায়, ভেলাসকো জানতেন—প্রগতি তার প্রিয় ভূদৃশ্যকে বদলে দেবে।
বর্তমান মেক্সিকো ও ভেলাসকোর উত্তরাধিকার
আজকের দিনে ভেলাসকোর সেই উপত্যকা আর আগের মতো নেই; বিশাল মেক্সিকো সিটি তার অধিকাংশ দখল করেছে। তবু ‘ভ্যালি অব মেক্সিকো’ এখনো জাতীয় প্রতীক, জাতীয় গৌরবের অংশ। এই প্রদর্শনী মনে করিয়ে দেয়—ইতিহাস ও প্রকৃতিকে একসঙ্গে ক্যানভাসে বন্দি করার কৌশলে ভেলাসকো ছিলেন এক অনন্য শিল্পী। তাঁর তুলির আঁচড়ে মেক্সিকো শুধু দৃশ্য নয়, আত্মপরিচয়ও খুঁজে পেয়েছিল।
প্রদর্শনীর তথ্য
হোসে মারিয়া ভেলাসকো: এ ভিউ অব মেক্সিকো
স্থান: মিনিয়াপোলিস ইনস্টিটিউট অব আর্ট
সময়কাল: জানুয়ারি ৪, ২০২৬ পর্যন্ত প্রদর্শিত থাকবে
#হোসে_মারিয়া_ভেলাসকো #মেক্সিকো #চিত্রকলা #জাতীয়_পরিচয় #শিল্প_প্রদর্শনী #মিনিয়াপোলিস_ইনস্টিটিউট_অব_
সারাক্ষণ রিপোর্ট 
























