শিবলী আহম্মেদ সুজন
কতগুলি বাঁশের ফলা গোল করে বেঁধে নিয়ে তার ভিতরে একটি বাঁশের কঞ্চি লাগিয়ে দেওয়া হয; কঞ্চির এক পাশে একটি নারিকেলের মালা গাঁথা থাকে। সুতা মোড়ান প্রথমে বাঁশের ফলা এবং নাটাই দুইটি পাশাপাশি রেখে তাঁতির দুই পায়ের আঙ্গুলের সাহায্যে খাড়া করে রাখা হয়। এরপর এক হাতে সুতা সাথে ফলা ধরে অন্য হাতে নাটাই ঘুরিয়ে সুতাগুলি ফলা থেকে নাটাইয়ে ভরে নেওয়া হয়।
এই ভাবে প্রয়োজন মত সুতা মোড়ান হলে, সুতার মোড়াগুলি পানিতে ডুবিয়ে দেওয়া হয়। পরে সুতার মোড়াকে কঞ্চির ভিতরে রেখে ভাল করে মোচড়ান হয় যাতে পানি নিঃশেষ হয়ে বের হয়ে যায়। ঐ ভাবেই কঞ্চির ভিতরে রেখে সুতা দুই এক দিনের জন্য রৌদ্রের তাপে রেখে দেওয়া হয়। এর পর তাঁতিরা আবার সুতা পরীক্ষা করে দেখে। যদি কোন সুতা অতিরিক্ত সূক্ষ্ম বা অতিরিক্ত মোটা হওয়ার দরুণ বুননের অযোগ্য বিবেচিত হয় তাকে বাদ দেওয়া হয়। সুতাগুলিকে এরপর কাঠ কয়লার গুঁড়া মিশ্রিত পানিতে দুইদিন ভিজিয়ে রাখা হয়।
কোন কোন সময় চুলায় রান্না করার ফলে মাটির পাত্রে যে কালি জন্মে তাও সংগ্রহ করে ব্যবহার করা হয়। এর পর সুতাগুলিকে বের করে পরিষ্কার পানিতে ধুয়ে নিঙড়িয়ে পানি নিঃশেষ করে বের করে কঞ্চির ভিতরে করে ছায়ায় শুকাতে দেওয়া হয়। প্রত্যেক মোড়া সুতা আবার নাটাই-এ গুটিয়ে এক রাতের জন্য পানিতে ডুবিয়ে রাখা হয় এবং পরদিন সকালে খুলে একটা কাঠের তক্তার উপর বিছিয়ে রাখা হয়।
ঐ অবস্থায় সুতাগুলিকে খৈ-এর মাড় এবং চূণ মিশ্রিত পানির সাহায্যে মোলায়েম করা হয়। এই ভাবে মজবুত করার পর সুতাগুলিকে বড় নাটাই-এ মোড়ান হয় এবং রোদে শুকাতে দেওয়া হয়। নাটাই-এর উপর সুতা এমন পাতলা ভাবে ছড়িয়ে দেওয়া হয় যাতে সুতা তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যায়। অতঃপর সুতাগুলিকে আবার পরীক্ষা করে সূক্ষ্মতার পরিপ্রেক্ষিতে তিন ভাগে ভাগ করা হয়। এর প্রথম ভাগ টানার ডান দিকে, দ্বিতীয় ভাগ টানার বাম দিকে এবং তৃতীয় ভাগ টানার মাঝখানে ব্যবহৃত হয়; ডোরা-কাটা (striped) বা ছক কাটা (chequered) মসলিনের টানা সুতা তৈরী করতে হলে প্রথমেই প্রয়োজন মত ২টা সুতা বা ৪টা সুতা পাক দিয়ে নিয়ে তারপর উপরোক্ত পদ্ধতিতে সুতা তৈরী করা হয়।
বানা সুতা কাপড় তৈরীর মাত্র দুইদিন আগে ছাড়া মজবুত করা হয়না। সাধারণতঃ একদিনের কাজের পরিমাণ সুতা চব্বিশ ঘন্টার জন্য পানিতে ডুবিয়ে রাখা হয়। পরদিন সকালে সুতাগুলি মোচড়িয়ে বড় নাটাই-এ গুটান হয় এবং এর পর উপরোক্ত নিয়মে খৈ এবং চূণ মিশ্রিত পানি মেখে মজবুত করে নেওয়া হয়। অতঃপর প্রথমে ছোঁট এবং পরে বড় নাটাই-এ ভরে ছায়ায় শুকাতে দেওয়া হয়। এই ভাবে মজবুত করার পর সুতাগুলি বানার উপযুক্ত হয়। কাপড় বুনা সম্পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত দিনের পরিমাণ বানা সুতা এই ভাবে প্রত্যেক দিন মজবুত করে নেওয়া হয়।
টানা হোতান
সাধারণতঃ তাঁতির বসতবাড়ীর নিকটেই কোন খোলা জায়গায় টানা হোতান-এর কাজ চালান হয়। কাপড়ের পরিমাণের দিকে লক্ষ্য রেখে মাটিতে আড়াআড়ি ভাবে দুই সারি খুঁটি পোতা হয়। এরপর তাঁতি দুই কাঁচ গুড়া১৯ সুতা হাতে করে খুঁটির এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত এমন ভাবে আস্তে আস্তে হাঁটতে থাকে যাতে খুঁটিতে তাঁতির হাতের সুতার নাল লেগে থাকে। এভাবে যতক্ষণ পর্যন্ত টানা দেওয়া শেষ না হয় ততক্ষণ পর্যন্ত তাঁতি হাঁটতে থাকে। ডোরাকাটা (striped) এবং ছক কাটা (chequered) তৈরী করতে হলে, তাঁতি দুইটা কাঁচগুড়া নিয়ে হাঁটবে, কিন্তু একটি কাঁচগুড়ায় এক নাল সুতা এবং অন্য কাঁচগুড়ায় দুইটি বা চারটি সুতার নাল একসঙ্গে পাক দেওয়া থাকবে।
সানা বাঁধা
টানা হোতানের পরেই সানা বাঁধতে হয়। কিন্তু কোন কোন সময় নারদ বাঁধার পরেও সানা বাঁধা হয়। বাঁশের ফলা বা ছোট ছোট কঞ্চির তৈরী চাটাই-এর মত জিনিষকে সানা বলে। বাঁশের ফলাকে অত্যন্ত ছোট ছোট করে কেটে ঢাকার তাঁতিরা খুব সুন্দর ভাবে সানা তৈরী করে নিত। জেমস্ টেলর বলেন যে, ঢাকার ভালো সানাগুলি এত ছোট ছোট বাঁশের কঞ্চি দ্বারা তৈরী হত যে চল্লিশ ইঞ্চি দীর্ঘ সানায় ২৮০০ (দুই হাজার আট’শ) কঞ্চি থাকত। ২০ তৈরী হওয়ার পর টানা সুতা ভাঁজ করে তাঁতির ঘরের ছাদে (অথবা যে ঘরে তাঁত বসায় তার ছাদে।) এমন ভাবে ঝুলিয়ে রাখা হত যাতে নীচের দিকটা মাটির হাত খানিক উপরে ঝুলে থাকে। অনুরূপ ভাবে সানাও টানা সুতার পাশাপাশি ঝুলিয়ে রাখা হত।তারপর দুইজন তাঁতি টানা ও সানার দুই দিকে বসে রশি বা সুতা চালাচালি করে সানার সাথে টানার সুতাসমূহ বেঁধে ফেলে।
Leave a Reply