সোমবার, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০১:২৬ পূর্বাহ্ন

ফেনী কুমিল্লা নোয়াখালীতে বন্যার এই আগ্রাসী রূপ কেন?

  • Update Time : শনিবার, ২৪ আগস্ট, ২০২৪, ৩.৪০ পিএম

ফেনী জেলার মানুষের কাছে এবারের বন্যা একদিকে যেমন আকস্মিক অন্যদিকে অকল্পনীয়। শুধু ফেনী নয়, এর আশপাশের জেলাগুলোতে বন্যা আগ্রাসী রূপ ধারণ করেছে। বহু জায়গায় বন্যার পানি ঘরের চাল ছুঁয়েছে কিংবা উপচে গেছে।

ফেনীর পাশের জেলা কুমিল্লা, নোয়াখালী এবং চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে বন্যার তীব্রতা অনেককে হতবাক করেছে।

ভারত সীমান্তের লাগোয়া ফেনী জেলায় এই বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে নানা বিশ্লেষণ চলছে।

সামাজিক মাধ্যমের বিভিন্ন পোস্টের মাধ্যমে দেখা যাচ্ছে এই জেলাগুলোর বাসিন্দারা বলছেন, সেখানে ‘সচরাচর বন্যা হয় না’।

এর আগেও, বেশ কয়েকটি জেলায় বন্যার ক্ষেত্রে ‘অস্বাভাবিক’ বন্যার কথা শোনা গেছে। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, এই অঞ্চলগুলোতে সচরাচর বন্যা না হবার তথ্যটি সঠিক নয়।

বাংলাদেশে আকস্মিক বন্যার কবলে পড়ে এখন পর্যন্ত ১৩ জনের মৃত্যুর খবর জানিয়েছে দুর্যোগ মন্ত্রণালয়। এছাড়াও প্রায় ৪৫ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

এবারের বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে অন্তত ১১টি জেল, যেগুলোর মধ্যে আছে কুমিল্লা, ফেনী ও চট্টগ্রামও।

সামাজিক মাধ্যমে আলাপ

ভারতের ত্রিপুরা ও মিজোরামে কয়েকদিন ধরেই অতি বৃষ্টিপাত ও বন্যার খবর গণমাধ্যমে এলেও বাংলাদেশে এনিয়ে খুব বেশি সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি।

তবে দুদিন আগে ফেনী ও কুমিল্লা অঞ্চলে পানি ঢুকতে শুরু করলে বেশ সরব হয় ইন্টারনেট-ভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম।

বিশেষ করে এই অঞ্চলের মানুষ ‘বন্যায় অভ্যস্ত না এবং স্মরণকালে এমন বন্যা দেখেননি’ বলেও জানান কেউ কেউ।

এ হালিম নামের একজন ফেসবুক ব্যবহারকারী লিখেছেন, “আমরা কুমিল্লা চৌদ্দগ্রাম উত্তরের মানুষ বন্যা বা পানির সাথে মোকাবেলা করে থাকা অভ্যস্ত না, কারণ সচরাচর আমাদের এলাকায় বন্যা হয়না”।

আজিজুল হাকিম নিলয় নামে আরেকজন ফেসবুক ব্যবহারকারী লিখেছেন, “ফেনীতে সচরাচর বন্যা হয় না। এমন পরিস্থিতির অভিজ্ঞতা আগে কখনোই ছিলো না, প্রস্তুতিও ছিলনা”।

আগেও ডুবেছে চট্টগ্রাম ও সিলেট

এর আগে গত বছরের অগাস্টে অতিভারী বৃষ্টির কারণে চট্টগ্রাম ও বান্দরবানে পানিবন্দী হয়ে পড়ে কয়েক লাখ মানুষ।

সেসময় তিন দিনের ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে জেলাটিতে প্রায় শতাধিক পাহাড় ধসের ঘটনাও ঘটে।

বৃষ্টিপাতের অতীত রেকর্ডগুলোর মধ্যে ২০০৭ সালে ৬১০ মিলিমিটার পর্যন্ত বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছিল। সে সময় চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে ভূমিধসের কারণে ১২৮ জন মানুষ মারা যায়।

২০১১ সালে টানা ছয় দিনের ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে ১৯ জনের মৃত্যু হয়েছিল।

এছাড়া ২০১৭ সালে পুরো চট্টগ্রাম বিভাগজুড়ে ব্যাপক বৃষ্টির পর ভূমিধসে মোট ১৬৯ জন মানুষ নিহত হয়।

এর আগেও বেশ কয়েকটি জেলায় বন্যার ক্ষেত্রে ‘অস্বাভাবিক’ বন্যার কথা শোনা গেছে।

এছাড়াও সিলেটসহ হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজারেও প্রায়ই বন্যা দেখা যায়। বিশেষ করে ২০২২ সালে সিলেটে কয়েক দফা বন্যা হয়।

ভারতের আসাম ও মেঘালয়ে অতিবৃষ্টি একটি বড় কারণ হলেও এর বাইরে আরও কিছু উপাদান এসব বন্যার পেছনে কাজ করছে বলে জানায় বিশেষজ্ঞরা।

যেমন, নদীর পানি বহনের ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যাওয়া।

ওই অঞ্চলের নদীগুলোর নাব্যতা নষ্ট হয়ে যাওয়ায় মেঘালয় বা আসাম থেকে আসা বৃষ্টির অতিরিক্ত পানি নদী পথে হাওর থেকে বের হয়ে মেঘনা বা যমুনা হয়ে বঙ্গোপসাগরে চলে যেতে পারে না।

সেই সাথে, সিলেটসহ হাওর এলাকার অপরিকল্পিত উন্নয়নকেও এর জন্য দায়ী করেন অনেকে।

‘৩০ বছর আগেও এখানে প্রতি বছর বন্যা হতো’

সাধারণত দেশের উত্তরাঞ্চল, উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে সুরমা-কুশিয়ারা-ব্রক্ষ্মপুত্রের অববাহিকায় এবং দেশের অভ্যন্তরে অতি ভারী বৃষ্টিপাত হলে বন্যা দেখা দেয়।

তবে ৩০ বছর আগেও কুমিল্লা ও ফেনিতে প্রতি বছর বন্যা হতো বলে জানান পানি সম্পদ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ আইনুন নিশাত।

আর পাঁচ থেকে সাত বছর পর পর বড় সেখানে আকারের বন্যা হতো বলেও জানান তিনি।

“বন্যার কারণে গোমতীকে বলা হতো কুমিল্লার দুঃখ। এখন বন্যা না হবার কারণ হচ্ছে বাঁধ পানি ধরে রাখে। এই বাঁধটা ভারত করেছিল তাদের উপকারের জন্য, তাতে আমাদেরও কিছু উপকার হয়েছিল”।

এছাড়াও চট্টগ্রাম-রাঙ্গুনিয়াতেও আগে প্রতিবছরই বন্যা হতো বলেও জানান এই জলবায়ু বিশ্লেষক। আর কাপ্তাই বাঁধের কারণেই সাধারণত এদিকটায় বন্যা হয় না বলেও জানান তিনি।

তাহলে এবার কেন বন্যা হলো?

জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ আইনুন নিশাত

বিশ্লেষক আইনুন নিশাত বলছেন, সারা মাসে যে পরিমাণ বৃষ্টি হবার কথা, অগাস্ট মাসের মাঝের তিনদিনে তার চেয়ে বেশি বৃষ্টি হয়েছে।

এছাড়াও ত্রিপুরা মিজোরামসহ বাংলাদেশের ওই অঞ্চলে যে পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছে তা যদি ঢাকায় হতো, তাহলে ঢাকার ৮০ শতাংশ এলাকা ডুবে যেত বলেও মন্তব্য করেন এই বিশ্লেষক।

ফলে বন্যার জন্য অতিবৃষ্টির বিষয়টিকেই গুরুত্ব দিচ্ছেন এই বিশ্লেষক।

কুমিল্লা, ফেনী ও চট্টগ্রামে ‘বন্যা একেবারে হয় না, তাও না’। তবে অন্য বছরগুলোর তুলনায় এবছর বন্যা বেশি হয়েছে বলে জানান বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী সরদার উদয় রায়হান।

বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, “সাম্প্রতিক সময়ে কুমিল্লাতে অত বড় বন্যা হয় নাই। কিন্তু ফেনী, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজারে সাধারণত বন্যা হয়। এ বছর বড় পরিসরে বেশি এলাকাজুড়ে বন্যা হয়েছে, ফলে ক্ষয়ক্ষতি বেশি হয়েছে।

২০০৭ সালের পর কুমিল্লায় এবারই বড় আকারের বন্যা হয়েছে বলেও জানান তিনি। তবে হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজারে ২০১৮ সালেও এমন বন্যা দেখা যায়।

ম. ইনামুল হক

এই দুর্যোগকে অস্বাভাবিক মনে করছেন না জল পরিবেশ ইন্সটিউটের চেয়ারম্যান ম. ইনামুল হক।

বরং আগের থেকেই ফেনী বন্যাপ্রবণ এলাকা বলে জানান তিনি। আর মুহুরী-কহুয়া-সিলোনিয়া, এই তিনটি নদী জেলাটিকে বেষ্টিত করে রেখেছে।

তিনি বলেন, “নদীর পাশে বন্যা প্রতিরোধ বাধ আছে। এই বাধ অল্প বন্যা প্রতিরোধ করতে পারে, বড় বন্যা নয়”।

ফলে মিজোরাম ও ত্রিপুরায় যে ভারি বর্ষণ হয়েছে, তা উজান থেকে ভাটিতে নেমে এসেছে।

আর এর মধ্যে একটি প্রভাব রেখেছ স্থানিক নিম্নচাপ। কারণ স্থানিক নিম্নচাপ হলে মেঘ উত্তর দিকে সরে যেতে পারে না। ফলে একটি জায়গাতে বৃষ্টিপাত করতেই থাকে।

“স্থানীয়ভাবে নিম্নচাপ হয়েছে, যার ফলে অতি বৃষ্টি ও বন্যা হয়েছে”, বলেন তিনি।

বন্যার ঝুঁকিতে দেশের অর্ধেকেরও বেশি জনগোষ্ঠী

বন্যার উচ্চ ঝুঁকি

বাংলাদেশের বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে গত বছর অগাস্টে গ্রান্থাম রিসার্চ ইন্সটিটিউট অন ক্লাইমেট চেঞ্জ এন্ড দ্য এনভায়রমেন্ট ও সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ ইকোনমিক্স এন্ড পলিসি থেকে একটি সমীক্ষা প্রকাশিত হয়।

এতে বলা হয়, বাংলাদেশের ৬০ শতাংশ মানুষ বন্যার উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে।

এছাড়াও ১৯৭১ থেকে ২০১৪ সাল অর্থাৎ ৪৩ বছরে হওয়া ৭৮টি বন্যায় ৪১ হাজার ৭৮৩ জন মানুষ প্রাণ হারিয়েছে।

আর এতে অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে ১২ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারের।

এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (এডিবি) উদ্ধৃতি দিয়ে এতে বলা হয়, কেবল ২০১৪ সালের বন্যায় অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ দুই দশমিক দুই বিলিয়ন ডলার, যা দেশটির মোট জিডিপির প্রায় দেড় শতাংশ।

২০২২ সালের বন্যায় সাত দশমিক তিন মিলিয়ন মানুষ এবং এক বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হয়েছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

বিবিসি নিউজ বাংলা

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024