১২:৫৪ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৬ ডিসেম্বর ২০২৫

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ডিসেম্বর মাসে কী কী উৎসব হয়?

  • Sarakhon Report
  • ০২:৪৭:৪৮ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪
  • 28

যুক্তরাজ্যের কর্নওয়ালের কাউন্টির পেনজান্সে শীতকালীন অয়নকালে একটি অনুষ্ঠান।

ডিসেম্বর মাসে ক্রিসমাস বা বড়দিন পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত উৎসবের একটি। যা উত্তর গোলার্ধে শীতকালীন অয়নকাল এবং দক্ষিণ গোলার্ধে গ্রীষ্মকালীন অয়নকালের পরপরই উদযাপন শুরু হয়।

এই অয়নকাল বুঝতে বিশ্ব মানচিত্রের দিকে নজর দিতে হবে যেখানে উত্তর গোলার্ধে পড়েছে এশিয়া, ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা, আফ্রিকা মহাদেশের উত্তরাঞ্চল এবং দক্ষিণ আমেরিকার উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি দেশ ।

অন্যদিকে দক্ষিণ গোলার্ধে পড়েছে আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের দক্ষিণের অংশ, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, অ্যান্টার্কটিকা ।

পৃথিবী তার কক্ষপথে সূর্যের চারিদিকে ঘোরার কারণে উত্তর গোলার্ধে যখন শীতকাল থাকে তখন দক্ষিণ গোলার্ধে গরম পড়ে। একইভাবে যখন দক্ষিণ গোলার্ধে শীত থাকে তখন উত্তর গোলার্ধ থাকে গরম।

জ্যোতির্বিজ্ঞানের ভাষায়, উত্তর গোলার্ধে বছরের যে সময় দিনের আলো সবচেয়ে কম স্থায়ী থাকে বা দিন ছোট হয় সে সময়কে শীতকালীন অয়নকাল বলে।

যা সাধারণত ২১ বা ২২শে ডিসেম্বর ও এর আশেপাশের সময়ে অর্থাৎ শীত ঋতুর মাঝামাঝি সময়ে হয়ে থাকে, তখন সবচেয়ে বেশি ঠান্ডা পড়ে।

অন্যদিকে একই সময়ে দক্ষিণ গোলার্ধে গ্রীষ্মকালীন অয়নকাল থাকে। অর্থাৎ এই সময়ে ( ২১ বা ২২শে ডিসেম্বর ও এর আশেপাশের সময়) দক্ষিণ গোলার্ধ থাকে গরম, দিন থাকে বড়।

তাই বলা যায়, এই ডিসেম্বরে উত্তর গোলার্ধের মানুষ ঠান্ডার মধ্যে এবং দক্ষিণ গোলার্ধের মানুষ গরমের মধ্যে হাজার বছরের পুরোনো এই উৎসব একসাথে উদযাপন করে থাকে।

তবে আফ্রিকা মহাদেশটির দক্ষিণাঞ্চলের মানুষেরা ডিসেম্বর মাসে গ্রীষ্মকালীন অয়নকাল উপলক্ষে ঐতিহ্যবাহী প্রথম-ফসল উৎসব পালন করে থাকে।

ডংঝি ঐতিহ্য অনুসারে মাটন স্টু খাচ্ছে মানুষ।

ডিসেম্বরের শীতকালীন যতো উৎসব

ডংঝি (চীন)

ডংঝি একটি চীনা উৎসব যার বাংলা অর্থ হতে পারে “চরম শীত” বা “শীতের আগমন”।

চীনে এই উৎসব উদযাপনের উদ্ভব ঘটেছিল আড়াই বছর আগে হান রাজবংশের সময়কাল থেকে।

উৎসবটি শীতকালীন অয়নকালের প্রথম দিন থেকে শুরু করে পরবর্তী ১৫ দিন ধরে চলে।

উৎসবটি চীনের প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী ইয়িন এবং ইয়াং ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত। যা মূলত সম্প্রীতি এবং ভারসাম্যের প্রতীক।

যখন দিন ছোট হয়, তখন ইয়াং শক্তি অর্থাৎ উষ্ণতার ঘাটতি দেখা দেয় বলে মনে করা হয়।

তাই ডংঝিতে, মানুষ ইয়াং জাতীয় খাবার অর্থাৎ গরম খাবার খায়, যাতে তারা শীতের (ইয়িন) ঠান্ডাকে সামাল দিতে পারে।

এই খাবারের মধ্যে থাকে ট্যাংইউয়ান নামে আঠালো চালের বল জাতীয় খাবার, যা পুনর্মিলন এবং সমৃদ্ধির প্রতীক।

সেইসাথে থাকে চালের ময়ানে মোড়ানো মাংসের ডাম্পলিং, মাটন স্টু বা ভেড়ার মাংসের স্যুপ এবং বাবাও পরিজ যা কি না বীজ, বাদাম এবং শুকনো ফল দিয়ে তৈরি করা হয়।

ইয়ালদা ইরানে পালন হয়ে থাকে।

ইয়ালদা (ইরান)

ইয়ালদা হলো পাঁচ হাজার বছরের পুরোনো একটি ইরানি উৎসব। এই উৎসব শাব-ই ইয়ালদা বা জায়েশমেহর নামেও পরিচিত।

এটি শীতকালীন অয়নকালের শুরুর দিকে উদযাপিত হয় যা ইরানি ক্যালেন্ডারে শীতের প্রথম দিনও।

ইয়ালদা নামটি পুরনো সিরিয়াক শব্দ থেকে এসেছে, যার অর্থ “জন্ম”।

প্রাচীন পারস্যের জরথুস্ট্রবাদ ধর্মে, সূর্যদেবতা মিথ্রার পুনর্জন্ম পালনে এই উৎসব পালন করা হতো।

কারণ এই সময় থেকে গ্রীষ্মের অয়নকাল পর্যন্ত সূর্য আকাশে বেশি সময় ধরে থাকবে।

মিথ্রা পৃথিবীতে আলো, মঙ্গল এবং শক্তির প্রতীক। উৎসবটি জরথুস্ট্রবাদীরা মধ্যপ্রাচ্যের অন্য একটি ধর্ম, মিথ্রাইজম থেকে গ্রহণ করেছিল।

ইসলামের আগের পারস্যে ইয়ালদা ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎসবগুলোর একটি এবং এটি আজও ইরান ও বিশ্বজুড়ে জরথুস্ট্রবাদীরা উদযাপন করে থাকে।

অতীতে, ইয়ালদা উৎসবে বিভিন্ন উপহার দেওয়া হতো, সবুজ গাছপালা দিয়ে ঘর সাজানো হতো এবং একদিনের জন্য চাকরদের প্রভু বানানো হতো। অর্থাৎ চাকররা একদিনের জন্য তাদের প্রভুদের শাসন করার অনুমতি পেতো।

ধারণা করা হয়, রোমানরা তাদের শীতকালীন অয়নকালের উৎসব স্যাটার্নালিয়া পালনের সময় এই প্রথাগুলো গ্রহণ করেছিল। পরে এসব প্রথা ক্রিসমাসের ঐতিহ্যে যুক্ত হয়।

কাপাক রাইমি এমন এক সময় যখন তরুণদের ইনকা সাম্রাজ্যের যোদ্ধা হিসেবে দীক্ষা দেওয়া হতো।

কাপক রাইমি (পেরু ও ইকুয়েডর)

পেরু এবং ইকুয়েডরের কিছু মানুষ এখনো প্রাচীন ইনকা উৎসব কাপক রাইমি উদযাপন করে থাকে। কাপক রাইমি অর্থ ‘রাজ ভোজ’।

এই উৎসবের উদ্ভব ঘটেছিল ইনকা সাম্রাজ্যের সময়ে অর্থাৎ পনেরশ থেকে ষোড়শ শতকের কোনো এক সময়ে।

ইনকারা দক্ষিণ আমেরিকার পশ্চিম উপকূলের একটি বড় অংশ ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত শাসন করেছিল এবং এই উৎসব সূর্যদেবতা ইন্তির সম্মানে উদযাপন করত।

এটি শীতকালীন অয়নকালে উদযাপিত হতো যা ইনকা নববর্ষের প্রথম দিন। সহজভাবে বলতে গেলে ডিসেম্বরের ২১ তারিখের আশপাশের সপ্তাহগুলোয় এই উৎসব পালন হয়।

এই উৎসবে তারা পশু বলি দেয়, চিচা দে জোরা (ভুট্টার বিয়ার) পান করে, কোকা পাতা চাবায় এবং নাচে।

বলির ছাই সংগ্রহ করে নদীতে ফেলা হতো সৃষ্টির দেবতা বিরাকোচাকে উৎসর্গ করার জন্য।

এটি এমন একটি সময় ছিল যখন তরুণদের ইনকা সাম্রাজ্যের যোদ্ধা হিসেবে দীক্ষা দেওয়া হতো।

আজও পেরু এবং ইকুয়েডরের আন্দিজ অঞ্চলের কিছু গ্রামে প্যারেডের মাধ্যমে কাপক রাইমি উদযাপন করা হয়।

ইসওয়াতিনিতে গ্রীষ্মের মাঝামাঝি ইনকওয়ালা উৎসবে রাজার সম্মানে যোদ্ধারা নাচছেন।

উৎসবের অংশ হিসেবে, ছয় বা সাত বছর বয়সী বালকরা তাদের প্রথম জোড়া ট্রাউজার বা ফুল প্যান্টস পেতো কারণ এর আগে তারা মেয়েদের মতো হাঁটু-লম্বা পোশাক পরত।

অন্যদিকে, মেয়েদের চুল সাজাতে প্রথম ফিতা বা চুলের অলঙ্কার দেয়া হতো।

মনে করা হয়, বাবা-মায়েরা সন্তানদের প্রথম সাত বছরের প্রবণতা ও ক্ষমতা দেখার ভিত্তিতে তাদের কোন দক্ষতা শেখানো উচিত তা ঠিক করতেন।

উৎসবের অংশ হিসেবে, রাজকীয় পরিবারের ছেলেরা তাদের প্রথম কানের দুল পেত, যা শুধুমাত্র রাজপরিবারের লোকেরা পরতে পারত। এই অনুষ্ঠানকে ওয়ারাচিকুয়ি বলা হতো।

অন্যদিকে গ্রীষ্মকালীন অয়নকালের পরের মাসে কাপক রাইমি কামাই কুইল্লা পালন করতো ইনকারা। এটি হলো তাদের চাঁদের উৎসব। ইন্তি যেমন তাদের সূর্যদেবতা তেমনি কুইল্লা তাদের চন্দ্রদেবী। যারা যথাক্রমে জীবনের পুরুষত্ব এবং নারীত্বের প্রতীক।

কাপক রাইমি কামাই কুইল্লা কতদিন চলবে তা নির্ভর করত গ্রীষ্মকালীন অয়নকালের পরে নতুন চাঁদ কখন দেখা যায় তার ওপর। ফলে, ইনকাদের এসব উৎসবের সময়কাল কমবেশি হতো।

স্পেনীয়দের আগমনের আগে এগুলো ইনকাদের প্রধান উৎসব ছিল। এসব উৎসবের রীতিনীতি এবং অনুষ্ঠান বেশ জটিল ছিল যা ক্যাথলিক ধর্মের প্রভাবের কারণে এখন আগের মতো উদযাপিত হয় না।

ইনকার মূল উদযাপন ক্যাথলিক ধারণার সাথে মিশে একটি নতুন রূপ পেয়েছে।

জুলু জাতির রাজা, গুডউইল জুয়েলথিনি, তার উমখোসি ওয়াকওয়েশওয়ামা প্রথম ফসল উৎসব পুনরায় চালু করেন।

প্রথম-ফসল উৎসব (আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চল)

আফ্রিকার দক্ষিণে অনেক অঞ্চলে, গ্রীষ্মকালীন অয়নকাল এখনো প্রথম-ফসল উৎসব হিসেবে পালন হয়ে থাকে। এটি মূলত ফসল কাটার ঋতু শুরুর সময়।

এই উৎসবটি ভাকা সম্প্রদায়ের কাছে ইংকুবে, নেডেবেলে সম্প্রদায়ের কাছে ইনক্সওয়ালা, সোয়াজি সম্প্রদায়ের কাছে ইনকওয়ালা, এবং জুলু সম্প্রদায়ের কাছে উমখোসি ওকওয়েশওয়ামা নামে পরিচিত।

এই সময়ে পরিবারের প্রধান কর্তা/কর্ত্রী বছরের প্রথম ফসলের স্বাদ গ্রহণ করেন এবং এর মাধ্যমে পরিবার অন্য সদস্যদের সেই ফসল খাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়।

আবার এটি এমন এক সময় যখন জাতির শাসক প্রথম ফসল আস্বাদন করেন। এরপর পশু বলি দেওয়া হয় এবং শাসক একটি কলাবশ (বুনো লাউ) থেঁতলে বোঝায় যে প্রজারা ফসলের স্বাদ উপভোগ করতে পারে। অর্থাৎ সবাইকে ফসল খাওয়ার অনুমতি দেয়া হতো।

১৮৭৯ সালে জুলুদের সাথে যুদ্ধের মাধ্যমে সেখানকার জনগণের ভূখণ্ড দখল করার পর তাদের এই উৎসবটি নিষিদ্ধ করে ব্রিটিশরা।

তবে, ১৯৯০ সালে জুলু জাতির রাজা গুডউইল জুয়েলিথিনি উৎসবটি পুনরায় চালু করেন, এবং তখন থেকে প্রতি বছর দক্ষিণ আফ্রিকার নোঙ্গোমার এনয়োকেনি রাজপ্রাসাদে এই উৎসব অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।

বিগ ইনকওয়ালা নামে পরিচিত প্রথম-ফলের উৎসবটি আফ্রিকার দক্ষিণে ইসোয়াতিনি অঞ্চলের (আগে যা সোয়াজিল্যান্ড নামে পরিচিত ছিল) একটি প্রধান সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।

কোয়ানজা নামে আধুনিক আফ্রো-আমেরিকান উত্সবটি ঐতিহ্যবাহী প্রথম ফসল উত্সব থেকে উদ্ভূত হয়েছে।

উৎসবটি ছয় দিন ধরে চলে এবং এই সময়ে ইসোয়াতিনির মানুষ রাজতন্ত্র উদযাপন করে। এই উৎসব চলাকালে রাজার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে যোদ্ধারা তার জমির আগাছা পরিষ্কার করে।

প্রথম ফসলের উৎসব আত্মা পরিশুদ্ধ করা এবং কোনো কিছু নতুন করে শুরু করার সময় হিসেবেও বিবেচিত হয়।

আফ্রো আমেরিকানদের আধুনিক এক উৎসব ‘কোয়ানজা’-র উদ্ভব ঘটেছে ওই প্রাচীন উৎসব থেকেই।

আফ্রিকান-আমেরিকানরা ২৬শে ডিসেম্বর থেকে পহেলা জানুয়ারি পর্যন্ত এই উৎসব উদযাপন করে থাকে।

“কোয়ানজা” নামটি এসেছে মাতুন্ডা ইয়া কোয়ানজা থেকে, যা সোয়াহিলি ভাষায় “প্রথম ফসল” বোঝাতে ব্যবহৃত হয়।

১৯৬৬ সালে ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির আফ্রিকান স্টাডিজের অধ্যাপক মাওলানা রন কারেঙ্গা কোয়ানজার ধারণা সামনে আনেন।

এর উদ্দেশ্য ছিল আফ্রিকান-আমেরিকান জনগণের মধ্যে ঐতিহ্যবাহী আফ্রিকান পারিবারিক এবং সামাজিক মূল্যবোধ প্রচার করা।

বিবিসি নিউজ বাংলা

জনপ্রিয় সংবাদ

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ডিসেম্বর মাসে কী কী উৎসব হয়?

০২:৪৭:৪৮ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪

ডিসেম্বর মাসে ক্রিসমাস বা বড়দিন পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত উৎসবের একটি। যা উত্তর গোলার্ধে শীতকালীন অয়নকাল এবং দক্ষিণ গোলার্ধে গ্রীষ্মকালীন অয়নকালের পরপরই উদযাপন শুরু হয়।

এই অয়নকাল বুঝতে বিশ্ব মানচিত্রের দিকে নজর দিতে হবে যেখানে উত্তর গোলার্ধে পড়েছে এশিয়া, ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা, আফ্রিকা মহাদেশের উত্তরাঞ্চল এবং দক্ষিণ আমেরিকার উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি দেশ ।

অন্যদিকে দক্ষিণ গোলার্ধে পড়েছে আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের দক্ষিণের অংশ, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, অ্যান্টার্কটিকা ।

পৃথিবী তার কক্ষপথে সূর্যের চারিদিকে ঘোরার কারণে উত্তর গোলার্ধে যখন শীতকাল থাকে তখন দক্ষিণ গোলার্ধে গরম পড়ে। একইভাবে যখন দক্ষিণ গোলার্ধে শীত থাকে তখন উত্তর গোলার্ধ থাকে গরম।

জ্যোতির্বিজ্ঞানের ভাষায়, উত্তর গোলার্ধে বছরের যে সময় দিনের আলো সবচেয়ে কম স্থায়ী থাকে বা দিন ছোট হয় সে সময়কে শীতকালীন অয়নকাল বলে।

যা সাধারণত ২১ বা ২২শে ডিসেম্বর ও এর আশেপাশের সময়ে অর্থাৎ শীত ঋতুর মাঝামাঝি সময়ে হয়ে থাকে, তখন সবচেয়ে বেশি ঠান্ডা পড়ে।

অন্যদিকে একই সময়ে দক্ষিণ গোলার্ধে গ্রীষ্মকালীন অয়নকাল থাকে। অর্থাৎ এই সময়ে ( ২১ বা ২২শে ডিসেম্বর ও এর আশেপাশের সময়) দক্ষিণ গোলার্ধ থাকে গরম, দিন থাকে বড়।

তাই বলা যায়, এই ডিসেম্বরে উত্তর গোলার্ধের মানুষ ঠান্ডার মধ্যে এবং দক্ষিণ গোলার্ধের মানুষ গরমের মধ্যে হাজার বছরের পুরোনো এই উৎসব একসাথে উদযাপন করে থাকে।

তবে আফ্রিকা মহাদেশটির দক্ষিণাঞ্চলের মানুষেরা ডিসেম্বর মাসে গ্রীষ্মকালীন অয়নকাল উপলক্ষে ঐতিহ্যবাহী প্রথম-ফসল উৎসব পালন করে থাকে।

ডংঝি ঐতিহ্য অনুসারে মাটন স্টু খাচ্ছে মানুষ।

ডিসেম্বরের শীতকালীন যতো উৎসব

ডংঝি (চীন)

ডংঝি একটি চীনা উৎসব যার বাংলা অর্থ হতে পারে “চরম শীত” বা “শীতের আগমন”।

চীনে এই উৎসব উদযাপনের উদ্ভব ঘটেছিল আড়াই বছর আগে হান রাজবংশের সময়কাল থেকে।

উৎসবটি শীতকালীন অয়নকালের প্রথম দিন থেকে শুরু করে পরবর্তী ১৫ দিন ধরে চলে।

উৎসবটি চীনের প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী ইয়িন এবং ইয়াং ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত। যা মূলত সম্প্রীতি এবং ভারসাম্যের প্রতীক।

যখন দিন ছোট হয়, তখন ইয়াং শক্তি অর্থাৎ উষ্ণতার ঘাটতি দেখা দেয় বলে মনে করা হয়।

তাই ডংঝিতে, মানুষ ইয়াং জাতীয় খাবার অর্থাৎ গরম খাবার খায়, যাতে তারা শীতের (ইয়িন) ঠান্ডাকে সামাল দিতে পারে।

এই খাবারের মধ্যে থাকে ট্যাংইউয়ান নামে আঠালো চালের বল জাতীয় খাবার, যা পুনর্মিলন এবং সমৃদ্ধির প্রতীক।

সেইসাথে থাকে চালের ময়ানে মোড়ানো মাংসের ডাম্পলিং, মাটন স্টু বা ভেড়ার মাংসের স্যুপ এবং বাবাও পরিজ যা কি না বীজ, বাদাম এবং শুকনো ফল দিয়ে তৈরি করা হয়।

ইয়ালদা ইরানে পালন হয়ে থাকে।

ইয়ালদা (ইরান)

ইয়ালদা হলো পাঁচ হাজার বছরের পুরোনো একটি ইরানি উৎসব। এই উৎসব শাব-ই ইয়ালদা বা জায়েশমেহর নামেও পরিচিত।

এটি শীতকালীন অয়নকালের শুরুর দিকে উদযাপিত হয় যা ইরানি ক্যালেন্ডারে শীতের প্রথম দিনও।

ইয়ালদা নামটি পুরনো সিরিয়াক শব্দ থেকে এসেছে, যার অর্থ “জন্ম”।

প্রাচীন পারস্যের জরথুস্ট্রবাদ ধর্মে, সূর্যদেবতা মিথ্রার পুনর্জন্ম পালনে এই উৎসব পালন করা হতো।

কারণ এই সময় থেকে গ্রীষ্মের অয়নকাল পর্যন্ত সূর্য আকাশে বেশি সময় ধরে থাকবে।

মিথ্রা পৃথিবীতে আলো, মঙ্গল এবং শক্তির প্রতীক। উৎসবটি জরথুস্ট্রবাদীরা মধ্যপ্রাচ্যের অন্য একটি ধর্ম, মিথ্রাইজম থেকে গ্রহণ করেছিল।

ইসলামের আগের পারস্যে ইয়ালদা ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎসবগুলোর একটি এবং এটি আজও ইরান ও বিশ্বজুড়ে জরথুস্ট্রবাদীরা উদযাপন করে থাকে।

অতীতে, ইয়ালদা উৎসবে বিভিন্ন উপহার দেওয়া হতো, সবুজ গাছপালা দিয়ে ঘর সাজানো হতো এবং একদিনের জন্য চাকরদের প্রভু বানানো হতো। অর্থাৎ চাকররা একদিনের জন্য তাদের প্রভুদের শাসন করার অনুমতি পেতো।

ধারণা করা হয়, রোমানরা তাদের শীতকালীন অয়নকালের উৎসব স্যাটার্নালিয়া পালনের সময় এই প্রথাগুলো গ্রহণ করেছিল। পরে এসব প্রথা ক্রিসমাসের ঐতিহ্যে যুক্ত হয়।

কাপাক রাইমি এমন এক সময় যখন তরুণদের ইনকা সাম্রাজ্যের যোদ্ধা হিসেবে দীক্ষা দেওয়া হতো।

কাপক রাইমি (পেরু ও ইকুয়েডর)

পেরু এবং ইকুয়েডরের কিছু মানুষ এখনো প্রাচীন ইনকা উৎসব কাপক রাইমি উদযাপন করে থাকে। কাপক রাইমি অর্থ ‘রাজ ভোজ’।

এই উৎসবের উদ্ভব ঘটেছিল ইনকা সাম্রাজ্যের সময়ে অর্থাৎ পনেরশ থেকে ষোড়শ শতকের কোনো এক সময়ে।

ইনকারা দক্ষিণ আমেরিকার পশ্চিম উপকূলের একটি বড় অংশ ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত শাসন করেছিল এবং এই উৎসব সূর্যদেবতা ইন্তির সম্মানে উদযাপন করত।

এটি শীতকালীন অয়নকালে উদযাপিত হতো যা ইনকা নববর্ষের প্রথম দিন। সহজভাবে বলতে গেলে ডিসেম্বরের ২১ তারিখের আশপাশের সপ্তাহগুলোয় এই উৎসব পালন হয়।

এই উৎসবে তারা পশু বলি দেয়, চিচা দে জোরা (ভুট্টার বিয়ার) পান করে, কোকা পাতা চাবায় এবং নাচে।

বলির ছাই সংগ্রহ করে নদীতে ফেলা হতো সৃষ্টির দেবতা বিরাকোচাকে উৎসর্গ করার জন্য।

এটি এমন একটি সময় ছিল যখন তরুণদের ইনকা সাম্রাজ্যের যোদ্ধা হিসেবে দীক্ষা দেওয়া হতো।

আজও পেরু এবং ইকুয়েডরের আন্দিজ অঞ্চলের কিছু গ্রামে প্যারেডের মাধ্যমে কাপক রাইমি উদযাপন করা হয়।

ইসওয়াতিনিতে গ্রীষ্মের মাঝামাঝি ইনকওয়ালা উৎসবে রাজার সম্মানে যোদ্ধারা নাচছেন।

উৎসবের অংশ হিসেবে, ছয় বা সাত বছর বয়সী বালকরা তাদের প্রথম জোড়া ট্রাউজার বা ফুল প্যান্টস পেতো কারণ এর আগে তারা মেয়েদের মতো হাঁটু-লম্বা পোশাক পরত।

অন্যদিকে, মেয়েদের চুল সাজাতে প্রথম ফিতা বা চুলের অলঙ্কার দেয়া হতো।

মনে করা হয়, বাবা-মায়েরা সন্তানদের প্রথম সাত বছরের প্রবণতা ও ক্ষমতা দেখার ভিত্তিতে তাদের কোন দক্ষতা শেখানো উচিত তা ঠিক করতেন।

উৎসবের অংশ হিসেবে, রাজকীয় পরিবারের ছেলেরা তাদের প্রথম কানের দুল পেত, যা শুধুমাত্র রাজপরিবারের লোকেরা পরতে পারত। এই অনুষ্ঠানকে ওয়ারাচিকুয়ি বলা হতো।

অন্যদিকে গ্রীষ্মকালীন অয়নকালের পরের মাসে কাপক রাইমি কামাই কুইল্লা পালন করতো ইনকারা। এটি হলো তাদের চাঁদের উৎসব। ইন্তি যেমন তাদের সূর্যদেবতা তেমনি কুইল্লা তাদের চন্দ্রদেবী। যারা যথাক্রমে জীবনের পুরুষত্ব এবং নারীত্বের প্রতীক।

কাপক রাইমি কামাই কুইল্লা কতদিন চলবে তা নির্ভর করত গ্রীষ্মকালীন অয়নকালের পরে নতুন চাঁদ কখন দেখা যায় তার ওপর। ফলে, ইনকাদের এসব উৎসবের সময়কাল কমবেশি হতো।

স্পেনীয়দের আগমনের আগে এগুলো ইনকাদের প্রধান উৎসব ছিল। এসব উৎসবের রীতিনীতি এবং অনুষ্ঠান বেশ জটিল ছিল যা ক্যাথলিক ধর্মের প্রভাবের কারণে এখন আগের মতো উদযাপিত হয় না।

ইনকার মূল উদযাপন ক্যাথলিক ধারণার সাথে মিশে একটি নতুন রূপ পেয়েছে।

জুলু জাতির রাজা, গুডউইল জুয়েলথিনি, তার উমখোসি ওয়াকওয়েশওয়ামা প্রথম ফসল উৎসব পুনরায় চালু করেন।

প্রথম-ফসল উৎসব (আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চল)

আফ্রিকার দক্ষিণে অনেক অঞ্চলে, গ্রীষ্মকালীন অয়নকাল এখনো প্রথম-ফসল উৎসব হিসেবে পালন হয়ে থাকে। এটি মূলত ফসল কাটার ঋতু শুরুর সময়।

এই উৎসবটি ভাকা সম্প্রদায়ের কাছে ইংকুবে, নেডেবেলে সম্প্রদায়ের কাছে ইনক্সওয়ালা, সোয়াজি সম্প্রদায়ের কাছে ইনকওয়ালা, এবং জুলু সম্প্রদায়ের কাছে উমখোসি ওকওয়েশওয়ামা নামে পরিচিত।

এই সময়ে পরিবারের প্রধান কর্তা/কর্ত্রী বছরের প্রথম ফসলের স্বাদ গ্রহণ করেন এবং এর মাধ্যমে পরিবার অন্য সদস্যদের সেই ফসল খাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়।

আবার এটি এমন এক সময় যখন জাতির শাসক প্রথম ফসল আস্বাদন করেন। এরপর পশু বলি দেওয়া হয় এবং শাসক একটি কলাবশ (বুনো লাউ) থেঁতলে বোঝায় যে প্রজারা ফসলের স্বাদ উপভোগ করতে পারে। অর্থাৎ সবাইকে ফসল খাওয়ার অনুমতি দেয়া হতো।

১৮৭৯ সালে জুলুদের সাথে যুদ্ধের মাধ্যমে সেখানকার জনগণের ভূখণ্ড দখল করার পর তাদের এই উৎসবটি নিষিদ্ধ করে ব্রিটিশরা।

তবে, ১৯৯০ সালে জুলু জাতির রাজা গুডউইল জুয়েলিথিনি উৎসবটি পুনরায় চালু করেন, এবং তখন থেকে প্রতি বছর দক্ষিণ আফ্রিকার নোঙ্গোমার এনয়োকেনি রাজপ্রাসাদে এই উৎসব অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।

বিগ ইনকওয়ালা নামে পরিচিত প্রথম-ফলের উৎসবটি আফ্রিকার দক্ষিণে ইসোয়াতিনি অঞ্চলের (আগে যা সোয়াজিল্যান্ড নামে পরিচিত ছিল) একটি প্রধান সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।

কোয়ানজা নামে আধুনিক আফ্রো-আমেরিকান উত্সবটি ঐতিহ্যবাহী প্রথম ফসল উত্সব থেকে উদ্ভূত হয়েছে।

উৎসবটি ছয় দিন ধরে চলে এবং এই সময়ে ইসোয়াতিনির মানুষ রাজতন্ত্র উদযাপন করে। এই উৎসব চলাকালে রাজার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে যোদ্ধারা তার জমির আগাছা পরিষ্কার করে।

প্রথম ফসলের উৎসব আত্মা পরিশুদ্ধ করা এবং কোনো কিছু নতুন করে শুরু করার সময় হিসেবেও বিবেচিত হয়।

আফ্রো আমেরিকানদের আধুনিক এক উৎসব ‘কোয়ানজা’-র উদ্ভব ঘটেছে ওই প্রাচীন উৎসব থেকেই।

আফ্রিকান-আমেরিকানরা ২৬শে ডিসেম্বর থেকে পহেলা জানুয়ারি পর্যন্ত এই উৎসব উদযাপন করে থাকে।

“কোয়ানজা” নামটি এসেছে মাতুন্ডা ইয়া কোয়ানজা থেকে, যা সোয়াহিলি ভাষায় “প্রথম ফসল” বোঝাতে ব্যবহৃত হয়।

১৯৬৬ সালে ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির আফ্রিকান স্টাডিজের অধ্যাপক মাওলানা রন কারেঙ্গা কোয়ানজার ধারণা সামনে আনেন।

এর উদ্দেশ্য ছিল আফ্রিকান-আমেরিকান জনগণের মধ্যে ঐতিহ্যবাহী আফ্রিকান পারিবারিক এবং সামাজিক মূল্যবোধ প্রচার করা।

বিবিসি নিউজ বাংলা