মঙ্গলবার, ২০ মে ২০২৫, ০৯:৪৪ অপরাহ্ন
শিরোনাম :

চিন্ময় দাস, মার্টিন লুথার কিং ও শক্ত বাঁধন

  • Update Time : বৃহস্পতিবার, ৮ মে, ২০২৫, ৮.০০ এএম

স্বদেশ রায়

ফুল বাগানের বাইরে ঘাসের ভেতর ফুটে থাকা অনেক সুন্দর ফুলকে পায়ে মাড়িয়েই কিছু মানুষ ফুল বাগানের সৌন্দর্য দেখতে যায়। তারা বাগানের সাজানো ফুল দেখে আনন্দিত হয়কেউ বা তুলে নিয়ে খোঁপায় বা কোটের পকেটে গুঁজে নেয় বাগানের ফুল। আর যে ফুলটি একই সৌন্দর্য নিয়ে বাগানের বাইরে ঘাসের ভেতর ফুটেছিলতার পাপড়িগুলো ছিঁড়ে যায় ওই সৌন্দর্যপিপাসুদের জুতোর চাপে।

সাম্প্রদায়িকতার মতো কূপমণ্ডুকতা যখন একটি সমাজে বা রাষ্ট্রে ভর করেতখন ওই সমাজের ধর্ম বা বর্ণ বা গোত্র সংখ্যালঘুদের অবস্থা হয় ফুলবাগানের বাইরের ওই ঘাসের ভেতর থাকা ফুলটির মতো। বাংলাদেশের চিন্ময় দাসও এখন এর চেয়ে বেশি কিছু নয়। তাই তাঁর ওপর যতই জুতোর চাপ পড়ুক না কেনতাতে সৌন্দর্যের কোনো ক্ষতি হবে না। এমনকি কিছু সৌন্দর্যপিপাসুদের দৃষ্টিসীমার অনেক বাইরে চলে গেছেন এখন চিন্ময় দাস।

যারা ভাগ্যবাদে বিশ্বাসীতারা এখন মেনে নেবেএটাই চিন্ময় দাসের নিয়তি। ভাগ্যই আসলে সব। মানুষের করার কিছু নেই। আর যারা বাঙালির দুই শ্রেষ্ঠতম সন্তানদার্শনিক রামমোহন ও রবীন্দ্রনাথ বারবার পড়েছেনতারা বলবে ভাগ্য মানুষকে নিজে হাতে তৈরি করতে হয়। এবং সেটা পাষাণের ভারী পাহাড় ঠেলে করলেও তৈরি করতে হয়। রামমোহনরবীন্দ্রনাথ ও তাঁদের অনুসারী এস ওয়াজেদ আলীকাজী নজরুল ইসলাম থেকে পরবর্তীকালে কাজী মোতাহার হোসেনকাজী আব্দুল ওদুদসৈয়দ মুজতবা আলীসকলেই মনে করতেন ভাগ্যকে নিজের মতো করেই গড়ে নিতে হয়। আর মানুষ যেন সেই ভাগ্য গড়তে পারেসে জন্য মানুষের চিন্তার স্বাধীনতার একটি সমাজ ও রাষ্ট্র তার দরকার।

তারুণ্যেযৌবনে তাঁদের রাষ্ট্রসমাজ ও স্বাধীন চিন্তার ভাগ্য নিজে হাতে তৈরি করার চিন্তা ও দর্শন অনেক বেশি বুকের ভেতর নাড়া দিত। কিন্তু গত দশ বছরের বেশি সময় ধরে ধীরে ধীরে কেন যেন সেই নাড়া কমে যেতে শুরু করেছে। বরং ভিন্নভাবে দেখতে পাইরামমোহন থেকে সৈয়দ মুজতবা আলীসকলেই যেন ভাগ্যের কাছে পরাজিত ব্যক্তি। কোনো রাষ্ট্র বা সমাজ তাঁদের কখনই গ্রহণ করেনি। এমনকি সৈয়দ মুজতবা আলী নিজের জন্য একটা দেশ ও স্বাধীন চিন্তার স্থান পাননি।

সেই সমাজ ও চিন্তার উত্তরাধিকার হিসেবে এখন যদি মনে করিচিন্ময় দাসের মতো একজন তরুণ সে তার সমাজে ও রাষ্ট্রে বিনা বাধায়সাবলীলভাবে সংখ্যালঘু মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারবেতা হলে তা হবে মস্ত ভুল চিন্তা। পৃথিবীতে যখন ধর্মবর্ণগোত্র ও লিঙ্গের নামে কিছু মানুষকে সমাজ ও রাষ্ট্র চেপে রাখতে চায়তখন তার বিপরীত স্রোতে চলা অনেক কঠিন কাজ। সে এক বিশাল সংগ্রাম। চিন্ময় যে পথে নেমেছেতার সঙ্গে কিছুটা হলেও মিল আছে মার্টিন লুথার কিং-এর। বর্ণবাদে অতিষ্ঠ ও অপমানিত হয়েও মার্টিন লুথার কিং যেমন আফ্রিকান আমেরিকানদের স্বার্থ নিয়ে কোনো আপস করেননিবরং বর্ণসাম্প্রদায়িক শক্তির হাতে নিহত হওয়াকে মেনে নিয়েছিলেন। সে মৃত্যু তাঁর আদর্শকে বেগবান করেছিল। অন্যদিকে আম্বেদকরের মতো জ্ঞানী ব্যক্তি শেষ জীবনে এসেনিজ যে ধর্মীয় ও বর্ণপরিচয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেনতা ত্যাগ করে ভিন্ন ধর্মবিশ্বাসে আশ্রয় নিয়ে পরাজিত একজন মানুষ হিসেবে মারা যান। তাই সংগ্রামের উদাহরণে মার্টিন লুথার কিংকে যে আসনে বসাতে পারবে পৃথিবীর ইতিহাসআম্বেদকরকে হয়তো সেখানে বসাতে পারবে না।

চিন্ময় তরুণ। সে সংসারত্যাগী এক পুরুষ। সে একটি সম্প্রদায়ের তরুণদের তাঁদের নিজ দেশে নিজের ভাগ্যের অধিকারী হওয়ার সংগ্রামে নেমেছে। সে বলতে চায়তার সম্প্রদায়ের তরুণরা এই সমাজ ও রাষ্ট্রের ফুলবাগানের ফুল। তারা বাগানের বাইরের ঘাসের ভেতর ফোটা ফুল নয়।

পৃথিবীতে এই দাবিএই সংগ্রাম এই প্রথম কোনো ভূখণ্ডে নয়। পৃথিবীর হাজার হাজার বছরের ইতিহাসেএর হাজার হাজার উদাহরণ আছে। সেই সব সংগ্রামেই দেখা গেছেরাষ্ট্র ও সমাজের একটি অংশ বারবারই আরেকটি অংশের নিজ হাতে নিজের ভাগ্য গড়ার অধিকার কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। আর এর বিপরীত সংগ্রামটিকে মূল্য দিতে হয়েছে আরও বেশি।

আর এই সংগ্রাম শুরু হলেসেটা স্নোবলের মতো বড় হতে থাকে। কখনও মনে করা উচিত হবে নাএই সংগ্রাম একদিনেএক ব্যক্তির মাধ্যমে শেষ হবে। এ সংগ্রাম যেমন স্নোবলের মতো বড় হয়তেমনি এ সংগ্রামের মশালও রিলে রেসের মতো একজন থেকে আরেকজনের হাতে তুলে দিতে হয়।

চিন্ময় যখন এ সমাজে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের অধিকার নিয়ে আন্দোলন শুরু করেছিলতখন আন্দোলনটি ছিল শুধু একটি ভাগ্যহত হিন্দু সম্প্রদায়ের। এখন তার সঙ্গে সঙ্গে দেখা যাচ্ছেসমাজের লিঙ্গবৈষম্যের শিকার থেকে মুক্তি পেয়ে যে নারীরা স্বাধীনভাবে নিজের ভাগ্য গড়তে চায়তাঁদেরও কেউ কেউ কথা বলতে শুরু করেছেনমুক্ত সমাজের জন্যনিজের ভাগ্য নিজে গড়ার জন্য। অর্থাৎ রাষ্ট্র ও সমাজে নিজের ভাগ্য নিজে গড়ার স্বাধীনতা পাওয়ার স্নোবলটি একটু হলেও বেড়েছে।

তাই চিন্ময় মুক্তি না পাকক্ষতি নেই। যেমন মার্টিন লুথার কিং মারা গিয়েছিলেনতাতে কোনো ক্ষতি হয়নি আফ্রিকান আমেরিকানদের অধিকার আন্দোলনে। আর বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায় এই মাটিরই আদি সন্তান। বাংলাদেশের যে নারীরা ভাগ্য নিজে গড়ার পথের বাধা সরাতে চানতারাও এই সমাজেরই অংশ। তারাও জন্মদাত্রীজায়া ও কন্যা।

তাই চিন্ময় দাস যদি জামিন না পায়কোনো ক্ষতি নেই যে আলো সে জ্বেলেছেওই আলোর শিখা উজ্জ্বল রাখতে। বরং তাঁর অনুসারীরা শুধু নয়মুক্ত সমাজকামী মানুষ খুশি হতে পারে রবীন্দ্রনাথকে মনে করে—বাঁধন যতই শক্ত হবেততই বাঁধন টুটবে

লেখক: রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিকসম্পাদক সারাক্ষণ’ ও The Present World.

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024