পর্যায় সারণির মাঝামাঝি অংশে এখন তুমুল আলোড়ন। ল্যান্থানাইড নামে পরিচিত ১৫টি উপাদানকে ঘিরে চলছে ভূরাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ ও কৌশলগত চাপানউতোর। অনন্য চৌম্বকীয়, অনুঘটক ও আলোক বিকিরণ-সংক্রান্ত গুণের জন্য এগুলো পরিচ্ছন্ন জ্বালানি বিপ্লবসহ বহু অগ্রসর প্রযুক্তির নীরব নায়ক হয়ে উঠেছে।
‘দুষ্প্রাপ্য মৃত্তিকা উপাদান’ নামে বেশি পরিচিত হলেও প্রকৃতপক্ষে এগুলো খুব একটা দুর্লভ নয়— কেবল গ্রহজুড়ে অসমভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে, অসংখ্য খনিজে মাত্র সামান্য অংশ জুড়ে থাকে। উত্তোলন জটিল, আর পরিশোধন ব্যয়সাপেক্ষ— ‘দুষ্প্রাপ্যতা’টি আসলে এখানে। উদাহরণস্বরূপ, নিয়োডিমিয়াম ও প্রাসিওডিমিয়াম সরাসরি চালিত উইন্ড টারবাইনের উচ্চ-দক্ষ চুম্বক তৈরিতে অপরিহার্য। ডিসপ্রোসিয়াম ও টার্বিয়াম বৈদ্যুতিক গাড়ির মোটর ও বৃহৎ উইন্ড জেনারেটরের নির্ভরযোগ্যতা বাড়ায়। লান্থানাম হাইব্রিড গাড়ি ও বিদ্যুৎ সঞ্চয় ব্যবস্থার নিকেল-মেটাল-হাইড্রাইড ব্যাটারির মূল উপাদান, আর সেরিয়াম সোলার প্যানেল তৈরিতে পালিশ-এজেন্ট হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ল্যান্থানাইড শ্রেণির বাইরে থাকা স্ক্যান্ডিয়াম ও ইট্রিয়ামকেও একই তালিকায় ধরা হয়, ফলে মোট দুষ্প্রাপ্য উপাদান ১৭টি।
রূপালি-সাদা এই ধাতুগুলো পর্যায় সারণির ৫৭-৭১ নম্বর আসনে আর সমসাময়িক ভূরাজনীতির কেন্দ্রস্থলে। সাম্প্রতিক যুক্তরাষ্ট্র-ইউক্রেন খনিজ চুক্তি— যা ওয়াশিংটনের কিয়েভ-সমর্থন অব্যাহত রাখার অর্থনৈতিক শর্ত হিসেবে দেখা হয়— বহু আকরিকের পাশাপাশি দুষ্প্রাপ্য উপাদানকেও অন্তর্ভুক্ত করেছে। মার্কিন শুল্কের পাল্টা জবাবে গত এপ্রিল চীন সাতটি দুষ্প্রাপ্য ধাতুর রপ্তানিতে নতুন অনুমতিপত্র বাধ্যতামূলক করেছে। এমনকি গ্রিনল্যান্ড ‘কেনার’ অবাক করা মার্কিন প্রচেষ্টার পেছনেও— যা ‘জাতীয় নিরাপত্তা ও বৈশ্বিক স্বাধীনতার জন্য একান্ত প্রয়োজন’ বলে বর্ণনা করা হয়েছিল— বরফ নিচে বিশাল দুষ্প্রাপ্য ধাতুর ভাণ্ডারই অন্যতম কারণ।
তবে এই (অ)কূটনৈতিক লড়াই শুধু শূন্য-নির্গমন প্রযুক্তির জন্য নয়; দুষ্প্রাপ্য উপাদান সামরিক ক্ষেত্রেও অপরিহার্য— যেমন ক্ষেপণাস্ত্র নির্দেশনা ব্যবস্থা ও যুদ্ধবিমান। তাই যুক্তরাষ্ট্র কাগজে-কলমে হলেও এর সরবরাহ নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায়। চীনের অবস্থান আরও শক্ত— বৈশ্বিক মজুতের প্রায় ৬৫ শতাংশ আর পরিশোধন ক্ষমতার ৯২ শতাংশ তাদের হাতে। ২০২৪ সালে মার্কিন প্রযুক্তিতে তৈরি উন্নত জিপিইউ চিপের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার জবাবে চীন জার্মেনিয়াম, গ্যালিয়াম ও অ্যান্টিমন রপ্তানি বন্ধ করে। অর্থাৎ উপাদানের লড়াই শুরু হয়ে গেছে— নির্মম, ঝুঁকিপূর্ণ ও অনিশ্চিত।
এতে পরিচ্ছন্ন প্রযুক্তি বিস্তারের ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জের মুখে। আন্তর্জাতিক জ্বালানি সংস্থার হিসেবে ২০৪০ সাল পর্যন্ত কেবল স্বচ্ছ শক্তি খাতের চাহিদা মেটাতে দুষ্প্রাপ্য উপাদানের উৎপাদন সাত গুণ বাড়াতে হবে। অনুমান অনুযায়ী নিয়োডিমিয়াম ও ডিসপ্রোসিয়ামের চাহিদা ২০৩০ ও ২০৫০ সালেই সরবরাহ ছাড়িয়ে যেতে পারে। বৈশ্বিক মজুতে ১৫.৫ শতাংশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র দ্বিতীয় স্থানে থাকলেও চলমান বড় মাত্রার খনি মাত্র একটি। নতুন খনি ও পরিশোধনাগার চালু হতে অনুসন্ধান থেকে পূর্ণ উৎপাদন পর্যন্ত দশ বছর লাগে। কয়েকটি ধাতুর ঘাটতিতে কি তবে উইন্ড জ্বালানি আর বৈদ্যুতিক গাড়ির গতি থমকে যাবে?
কিন্তু বিষয়টি শুধু জোগানই নয়, টেকসইতাও। তৃতীয় বৃহৎ মজুতধারী মিয়ানমারে ল্যান্থানাইড খনন ভয়াবহ— সিঙ্গাপুরের সমান এলাকায় বন উজাড়, খনিজ তুলতে মাটির ভেতর রাসায়নিক ঢুকিয়ে ভূগর্ভস্থ জলদাহ দূষণ। নিরাপদ পদ্ধতি এলেও নিস্কলুষ আর্কটিকে খনিজ তোলার ধারণা, যেখান থেকে টারবাইন ও ব্যাটারির উপকরণ আসবে কার্বন নিঃসরন কমাতে— বিরোধপূর্ণই বটে। তার চেয়েও অযৌক্তিক হলো ই-বর্জ্য থেকে এই মূল্যবান উপাদান উদ্ধার না করা; ২০২২ সালে বিশ্বজুড়ে ৬২ বিলিয়ন কেজি ই-বর্জ্য তৈরি হলেও পুনর্চক্রায়ন খুব সামান্যই।
কার্বনমুক্তির পথে সবচেয়ে বড় অগ্রগতি এসেছে রাজনৈতিক সদিচ্ছা থেকে নয়, বরং পরিষ্কার শক্তি প্রযুক্তির খরচ কমা ও দক্ষতা বাড়া থেকে। পথ এখনো কঠিনই রয়ে গেছে। উপাদানের এই যুদ্ধ যদি আমাদের আরো দ্রুত এগোনোর পথ রুদ্ধ করে দেয়, তা হবে সত্যিকারের দুর্ভাগ্য।