০৫:৫২ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৭ জুন ২০২৫

পাহাড়ের গভীরে ইরানের ‘ফোরদো’ পারমাণবিক ঘাঁটি: অনাবিষ্কৃত দুর্গ

ফোরদোপাহাড়ের বুকে গোপন শক্তিঘাঁটি

কোম শহরের কাছাকাছি পাহাড়ের নিচে ৮০৯০ মিটার গভীরে গড়ে ওঠা ফোরদো ইরানের সবচেয়ে সুরক্ষিত পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর একটি। ২০০২০৪ সালের মধ্যে নির্মাণকাজ শুরু হলেও২০০৯ সালে পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তথ্য ফাঁস না হলে এর অস্তিত্ব প্রকাশ্যে আসত না। এমন গভীরতা ও পাহাড়ি আস্তরণ একে সমসাময়িক বাংকার-ধ্বংসকারী বোমার আঘাত থেকে কার্যত নিরাপদ করে তুলেছে।

কেন বিশ্বশক্তির চোখ ফোরদোয়

আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থা (আইএইএ) জানায়এখানে ২,৭০০ সেন্ট্রিফিউজ ৬০ শতাংশ পর্যন্ত উচ্চসমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম উৎপাদন করছেযা অস্ত্র-মানের ৯০ শতাংশের মাত্র এক ধাপ নিচে। ২০২৩ সালে ৮৩.৭ শতাংশ সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের নমুনা মিলেছিলঅর্থাৎ ইরান চাইলে কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই প্রায় নয়টি পারমাণবিক বোমার জোগান দিতে পারেএমন আশঙ্কা বাড়ছে।

ইরানের মূল পারমাণবিক কেন্দ্রসমূহ

• নাতাঞ্জ: সবচেয়ে বড় সমৃদ্ধিকরণ কেন্দ্রভূগর্ভস্থ ও ভূ-উপরস্থ দুটি প্ল্যান্ট।
• ফোরদো: ২,০০০-এর বেশি সেন্ট্রিফিউজবর্তমানে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত সমৃদ্ধিকরণ।
• ইসফাহান: ইউরেনিয়াম রূপান্তর ও ফুয়েল প্লেট কারখানাপারমাণবিক ধাতু তৈরির সামর্থ্যও আছে।
• খন্দাব (আরাক): ভারী-জল রিঅ্যাক্টর২০২৬-এ চালু হয়ে প্লুটোনিয়াম উৎপাদন করতে পারে।
• তেহরান: গবেষণা কেন্দ্র ও একটি ছোট রিঅ্যাক্টর।
• বুশেহর: রাশিয়ার জ্বালানি সরবরাহে পরিচালিত একমাত্র বাণিজ্যিক পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র।

পাঁচ সুড়ঙ্গের অদৃশ্য সাম্রাজ্য

স্যাটেলাইট চিত্রে দেখা গেছেপাহাড়ের গায়ে পাঁচটি সুড়ঙ্গবিশাল সহায়ক অবকাঠামো ও প্রহরাবেষ্টিত চত্বরযার বেশির ভাগই মাটি আর শিলার নিচে চাপা। এতটাই গভীরে যেইসরায়েলের আধুনিক বোমাও ফোরদোর সমৃদ্ধিকরণ কক্ষ ধ্বংস করতে অক্ষম।

ইসরায়েলের হামলা ও যুক্তরাষ্ট্রের অপরিহার্যতা

ইসরায়েল এরই মধ্যে ফোরদো লক্ষ্য করে অভিযান চালিয়েছেকিন্তু আইএইএ বলছেস্থাপনাটির কার্যক্রম ব্যাহত হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের বোমা-বাহী বি-২ স্টিলথ বোমারু ও জিবিইউ-৫৭ ম্যাসিভ অর্ডন্যান্স পেনিট্রেটর’ ব্যতীত ফোরদো সম্পূর্ণ ধ্বংস করা কারও পক্ষে সম্ভব নয়। তাই শেষ পর্যন্ত ফোরদো নিয়ে সামরিক সিদ্ধান্তে ওয়াশিংটনের ভূমিকাই নির্ণায়ক।

বিকল্প হামলা-কৌশল কতটা কার্যকর?

বিশেষজ্ঞরা সুড়ঙ্গের প্রবেশমুখবায়ু প্রবাহের নালি বা বিদ্যুৎ সরবরাহে হামলা চালানোর পরামর্শ দেনযা সাময়িকভাবে কার্যক্রম স্থগিত করতে পারে। তবে তাতেও ইরানের পরমাণু সক্ষমতা চিরতরে অক্ষম করে দেওয়া যাবে নাকেবল কয়েক মাসের জন্য ধীর করা যাবে।

শান্তিপূর্ণ প্রকল্পের সঙ্গে ফোরদোর অমিল

২০০৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বলেছিলেন, “এই স্থাপনার আকার-আকৃতিই প্রমাণ করে যে এটি শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির অন্তর্গত নয়।” গোপনে নির্মাণগভীর সমাহিত অবস্থান ও দ্রুত অস্ত্র-মানের ইউরেনিয়াম তৈরির সক্ষমতাসবকিছুই ইঙ্গিত করে যে ফোরদো ইরানের কৌশলগত বিশেষ বীমা’ হিসেবে টিকে আছে।

ইরান দৃঢ়ভাবে দাবি করে আসছেতার পরমাণু কর্মসূচি শান্তিপূর্ণতবে ফোরদোর অস্তিত্ব ও সাম্প্রতিক সমৃদ্ধিকরণ মাত্রা বিশ্বকে ভিন্ন বার্তা দিচ্ছে। ইসরায়েলের সীমিত সামরিক বিকল্পযুক্তরাষ্ট্রের অনিশ্চিত সিদ্ধান্ত ও ইরানের চলমান সমৃদ্ধিকরণসব মিলিয়ে ফোরদো আজ মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতির অন্যতম শীর্ষ উদ্বেগের নাম।

পাহাড়ের গভীরে ইরানের ‘ফোরদো’ পারমাণবিক ঘাঁটি: অনাবিষ্কৃত দুর্গ

০৬:০০:৩৪ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৯ জুন ২০২৫

ফোরদোপাহাড়ের বুকে গোপন শক্তিঘাঁটি

কোম শহরের কাছাকাছি পাহাড়ের নিচে ৮০৯০ মিটার গভীরে গড়ে ওঠা ফোরদো ইরানের সবচেয়ে সুরক্ষিত পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর একটি। ২০০২০৪ সালের মধ্যে নির্মাণকাজ শুরু হলেও২০০৯ সালে পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তথ্য ফাঁস না হলে এর অস্তিত্ব প্রকাশ্যে আসত না। এমন গভীরতা ও পাহাড়ি আস্তরণ একে সমসাময়িক বাংকার-ধ্বংসকারী বোমার আঘাত থেকে কার্যত নিরাপদ করে তুলেছে।

কেন বিশ্বশক্তির চোখ ফোরদোয়

আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থা (আইএইএ) জানায়এখানে ২,৭০০ সেন্ট্রিফিউজ ৬০ শতাংশ পর্যন্ত উচ্চসমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম উৎপাদন করছেযা অস্ত্র-মানের ৯০ শতাংশের মাত্র এক ধাপ নিচে। ২০২৩ সালে ৮৩.৭ শতাংশ সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের নমুনা মিলেছিলঅর্থাৎ ইরান চাইলে কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই প্রায় নয়টি পারমাণবিক বোমার জোগান দিতে পারেএমন আশঙ্কা বাড়ছে।

ইরানের মূল পারমাণবিক কেন্দ্রসমূহ

• নাতাঞ্জ: সবচেয়ে বড় সমৃদ্ধিকরণ কেন্দ্রভূগর্ভস্থ ও ভূ-উপরস্থ দুটি প্ল্যান্ট।
• ফোরদো: ২,০০০-এর বেশি সেন্ট্রিফিউজবর্তমানে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত সমৃদ্ধিকরণ।
• ইসফাহান: ইউরেনিয়াম রূপান্তর ও ফুয়েল প্লেট কারখানাপারমাণবিক ধাতু তৈরির সামর্থ্যও আছে।
• খন্দাব (আরাক): ভারী-জল রিঅ্যাক্টর২০২৬-এ চালু হয়ে প্লুটোনিয়াম উৎপাদন করতে পারে।
• তেহরান: গবেষণা কেন্দ্র ও একটি ছোট রিঅ্যাক্টর।
• বুশেহর: রাশিয়ার জ্বালানি সরবরাহে পরিচালিত একমাত্র বাণিজ্যিক পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র।

পাঁচ সুড়ঙ্গের অদৃশ্য সাম্রাজ্য

স্যাটেলাইট চিত্রে দেখা গেছেপাহাড়ের গায়ে পাঁচটি সুড়ঙ্গবিশাল সহায়ক অবকাঠামো ও প্রহরাবেষ্টিত চত্বরযার বেশির ভাগই মাটি আর শিলার নিচে চাপা। এতটাই গভীরে যেইসরায়েলের আধুনিক বোমাও ফোরদোর সমৃদ্ধিকরণ কক্ষ ধ্বংস করতে অক্ষম।

ইসরায়েলের হামলা ও যুক্তরাষ্ট্রের অপরিহার্যতা

ইসরায়েল এরই মধ্যে ফোরদো লক্ষ্য করে অভিযান চালিয়েছেকিন্তু আইএইএ বলছেস্থাপনাটির কার্যক্রম ব্যাহত হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের বোমা-বাহী বি-২ স্টিলথ বোমারু ও জিবিইউ-৫৭ ম্যাসিভ অর্ডন্যান্স পেনিট্রেটর’ ব্যতীত ফোরদো সম্পূর্ণ ধ্বংস করা কারও পক্ষে সম্ভব নয়। তাই শেষ পর্যন্ত ফোরদো নিয়ে সামরিক সিদ্ধান্তে ওয়াশিংটনের ভূমিকাই নির্ণায়ক।

বিকল্প হামলা-কৌশল কতটা কার্যকর?

বিশেষজ্ঞরা সুড়ঙ্গের প্রবেশমুখবায়ু প্রবাহের নালি বা বিদ্যুৎ সরবরাহে হামলা চালানোর পরামর্শ দেনযা সাময়িকভাবে কার্যক্রম স্থগিত করতে পারে। তবে তাতেও ইরানের পরমাণু সক্ষমতা চিরতরে অক্ষম করে দেওয়া যাবে নাকেবল কয়েক মাসের জন্য ধীর করা যাবে।

শান্তিপূর্ণ প্রকল্পের সঙ্গে ফোরদোর অমিল

২০০৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বলেছিলেন, “এই স্থাপনার আকার-আকৃতিই প্রমাণ করে যে এটি শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির অন্তর্গত নয়।” গোপনে নির্মাণগভীর সমাহিত অবস্থান ও দ্রুত অস্ত্র-মানের ইউরেনিয়াম তৈরির সক্ষমতাসবকিছুই ইঙ্গিত করে যে ফোরদো ইরানের কৌশলগত বিশেষ বীমা’ হিসেবে টিকে আছে।

ইরান দৃঢ়ভাবে দাবি করে আসছেতার পরমাণু কর্মসূচি শান্তিপূর্ণতবে ফোরদোর অস্তিত্ব ও সাম্প্রতিক সমৃদ্ধিকরণ মাত্রা বিশ্বকে ভিন্ন বার্তা দিচ্ছে। ইসরায়েলের সীমিত সামরিক বিকল্পযুক্তরাষ্ট্রের অনিশ্চিত সিদ্ধান্ত ও ইরানের চলমান সমৃদ্ধিকরণসব মিলিয়ে ফোরদো আজ মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতির অন্যতম শীর্ষ উদ্বেগের নাম।