ইন্দোনেশিয়ায় শ্রমঘন শিল্পে ব্যাপক ছাঁটাই এবং বিশ্ববিদ্যালয় স্নাতকদের জন্য পর্যাপ্ত চাকরির সুযোগ না থাকায় সরকার দক্ষ শ্রমিকদের বিদেশে পাঠানোর উদ্যোগ জোরদার করেছে। এ পরিস্থিতিতে জাপান হয়ে উঠছে প্রধান গন্তব্য, যেখানে শ্রমবাজারে ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে।
নতুন চুক্তি ও লক্ষ্য
গত সপ্তাহে ইন্দোনেশিয়ার অভিবাসী শ্রমিক সুরক্ষা মন্ত্রণালয় ইন্দোনেশিয়ান বিজনেস কাউন্সিলের (আইবিসি) সঙ্গে একটি চুক্তি করে। এই চুক্তির মাধ্যমে জাপানের বেসরকারি খাতের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। মন্ত্রী আবদুল কাদির কার্ডিং বলেন, “জাপানের জনসংখ্যা দ্রুত বুড়ো হচ্ছে, আর আমাদের তরুণ প্রজন্ম বাড়ছে। আমরা চাই এই জনসংখ্যাগত সুবিধা যেন অভিশাপে পরিণত না হয়।”
জাপানের “নির্দিষ্ট দক্ষ শ্রমিক” কর্মসূচির অধীনে নার্সিং, লজিস্টিকস ও পরিবহন খাতে বিদেশি কর্মীদের নেয়া হচ্ছে। ২০২৯ সালের মার্চ পর্যন্ত এই কর্মসূচিতে সর্বোচ্চ ৮ লাখ ২০ হাজার কর্মী নেওয়ার পরিকল্পনা করেছে জাপান সরকার।
ইন্দোনেশিয়ার শ্রম রপ্তানির পরিবর্তিত ধারা
দীর্ঘদিন ধরে ইন্দোনেশিয়ার শ্রমিকরা বিদেশে কর্মসংস্থান করছে, তবে তা ছিল মূলত কমদক্ষ খাতে যেমন গৃহস্থালি কাজ, বাগান বা মধ্যপ্রাচ্যে সাধারণ শ্রম। এখন বিশ্ববিদ্যালয় স্নাতক তরুণরা উন্নত কর্মসংস্থানের জন্য জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশে যাচ্ছে।
শুধু জাপানেই ২০২৪ সালে নির্দিষ্ট দক্ষ ভিসাধারী ইন্দোনেশীয় শ্রমিকের সংখ্যা ৫৩ হাজারে পৌঁছেছে, যা ২০২৩ সালের তুলনায় উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি। এ বছর জুলাই পর্যন্ত আরও ১০ হাজারের বেশি শ্রমিক সেখানে যোগ দিয়েছেন। আগামী পাঁচ বছরে এই সংখ্যা ২ লাখ ৫০ হাজারে উন্নীত করার লক্ষ্য নিয়েছে সরকার।

জাপানে নতুন সুযোগ
জাপানি কোম্পানিগুলো এখন ইন্দোনেশীয় ট্রাক চালক ও নির্মাণশ্রমিকদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, দাইসান নামক একটি কোম্পানি ২০২৫ সালের মধ্যে ১৮০ জন ইন্দোনেশীয় স্ক্যাফোল্ডিং কর্মী এবং প্রতি মাসে ৫০ জন ট্রাকচালক প্রশিক্ষণের পরিকল্পনা করেছে। কোম্পানির সভাপতি তাকেতোশি ফুজিতা জানান, “ইন্দোনেশীয়রা নমনীয়, মিশুক এবং জাপানি সহকর্মীদের সঙ্গে ভালোভাবে কাজ করতে পারে।”
অন্যান্য দেশে কর্মসংস্থান
ইন্দোনেশিয়া শুধু জাপানেই নয়, দক্ষিণ কোরিয়া, জার্মানি, ব্রুনেই ও ইউরোপের কিছু দেশেও শ্রমিক পাঠাচ্ছে। সম্প্রতি ১৯১ জন কর্মী দক্ষিণ কোরিয়ায় গেছেন, আর ১১ জন নার্স গেছেন জার্মানিতে।
মন্ত্রণালয়ের সচিব শ্রী আন্দায়ানি বলেন, “আমরা ইন্দোনেশীয় কর্মীদের ইমেজ পরিবর্তন করতে চাই। আগে যেভাবে কমদক্ষ বা ঝুঁকিপূর্ণ কাজে যেত, এখন সেভাবে নয়—বরং দক্ষ পেশাজীবী হিসেবে পরিচিত করব।”
বাস্তব চিত্র: স্নাতকদের হতাশা ও বিদেশে ঝোঁক
দেশে কর্মসংস্থানের অভাবে অনেক তরুণ এখন জাপানে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে, রাশিয়ান সাহিত্য বিভাগ থেকে স্নাতক আরমা আধ্যে উরেশি ২০টির বেশি কোম্পানিতে আবেদন করেও চাকরি পাননি। তিনি জাপানের নাগানো প্রদেশের এক নার্সিং হোমে কাজের সুযোগ পেয়েছেন। সেখানে গিয়ে তিনি ইন্দোনেশিয়ার তুলনায় চার থেকে পাঁচ গুণ বেশি আয় করতে পারবেন।
অনোদেরা ইউজার রান নামের একটি জাপানি কোম্পানি জাকার্তায় প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছে, যেখানে বর্তমানে ২০০-এর বেশি ইন্দোনেশীয় তরুণ নার্স ও রেস্তোরাঁ কর্মী হিসেবে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। কোম্পানির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এখন এমনকি মাস্টার্স ডিগ্রিধারীরাও জাপানে যাওয়ার জন্য আবেদন করছেন।
অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট
দেশের ভেতরে টেক্সটাইল, জুতা, হোটেল-রেস্তোরাঁ থেকে শুরু করে প্রযুক্তি খাতে ছাঁটাই বেড়ে চলেছে। মার্কিন-চীন বাণিজ্য যুদ্ধ এবং ভূরাজনৈতিক অস্থিরতা পরিস্থিতিকে আরও কঠিন করছে। এই অবস্থায় সরকার বলছে বেকারত্বের হার ৪.৭৬ শতাংশ, যা ১৯৯৮ সালের পর সর্বনিম্ন। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের মানদণ্ডে সপ্তাহে মাত্র এক ঘণ্টা কাজকেও চাকরি হিসেবে ধরা হচ্ছে, যা বিভ্রান্তিকর।
ইন্দোনেশিয়া এখন দক্ষ শ্রমশক্তি বিদেশে পাঠানোর মাধ্যমে দেশের বেকারত্ব কমানোর চেষ্টা করছে। বিশেষ করে জাপান, যেখানে শ্রমঘাটতি প্রকট। তবে এর পেছনে দেশের অভ্যন্তরীণ সংকটও স্পষ্ট হয়ে উঠছে—যেখানে বিশ্ববিদ্যালয় স্নাতকরাও চাকরির সুযোগ পাচ্ছেন না। ফলে ইন্দোনেশীয় শ্রমিকরা জাপানের জন্য সমাধান হলেও, দেশীয় অর্থনীতির জন্য এটি একটি সতর্ক সংকেত।
 
																			 সারাক্ষণ রিপোর্ট
																সারাক্ষণ রিপোর্ট 								 


















