২০২৪ সালের আগস্টে শেখ হাসিনার পতনের পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও বৈদেশিক নীতিতে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ–পাকিস্তান বাণিজ্য সম্পর্ক পুনরুজ্জীবিত করার জন্য এই সফর অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। পাকিস্তানের উদ্দেশ্য দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ককে নতুনভাবে সাজানো।
অভ্যর্থনা ও প্রাথমিক আলোচনার সূচনা
ঢাকায় পৌঁছানোর পর বাণিজ্যমন্ত্রীকে স্বাগত জানান বাংলাদেশ সরকারের শিল্প উপদেষ্টা ও বাণিজ্য উপদেষ্টা। প্রাথমিক আলোচনায় দুই দেশের মধ্যে শিল্প ও বাণিজ্য খাতে নতুন সহযোগিতার সুযোগ নিয়ে মতবিনিময় হয়। পাকিস্তানের দিক থেকে স্পষ্ট বার্তা দেওয়া হয় যে, তারা বাংলাদেশের সঙ্গে একটি স্থায়ী ও সমন্বিত অংশীদারিত্ব গড়ে তুলতে চায়।
শিল্প ও বাণিজ্য সহযোগিতার বিষয়সমূহ
সফরে আলোচিত প্রথম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল শিল্প ক্ষেত্রে সহযোগিতা। খাদ্য নিরাপত্তা, পুষ্টি-ভিত্তিক শিল্পে মানোন্নয়ন এবং শিল্প প্রযুক্তির উন্নয়নে পারস্পরিক সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তা গুরুত্বসহকারে তুলে ধরা হয়। দুই পক্ষই যৌথ উদ্যোগে শিল্প খাতকে এগিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছে।

দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ–পাকিস্তান যৌথ অর্থনৈতিক কমিশন (Joint Economic Commission – JEC) পুনরুজ্জীবিত করার প্রক্রিয়া এবং একটি নতুন “বাণিজ্য ও বিনিয়োগ কমিশন” গঠনের পরিকল্পনা আলোচনায় উত্থাপিত হয়। এর মাধ্যমে দীর্ঘদিনের অচলাবস্থা কাটিয়ে উঠার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে।
তৃতীয়ত, ভারী শিল্প খাতে সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা হয়। বিশেষ করে চামড়া শিল্প, জাহাজ নির্মাণ, চিনি শিল্প, কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ (Small and Medium Enterprises – SMEs)–এ পারস্পরিক উদ্যোগ নেওয়ার সম্ভাবনা বিবেচনা করা হয়।
চতুর্থত, অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্ক ও চা রফতানি ইস্যু আলোচনায় আসে। বাংলাদেশ পাকিস্তানের কাছ থেকে হাইড্রোজেন পারঅক্সাইডে আরোপিত অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্ক প্রত্যাহারের অনুরোধ করে। অন্যদিকে পাকিস্তান ১০ মিলিয়ন কেজি পর্যন্ত শুল্কমুক্ত (Duty-free) চা রপ্তানির প্রতিশ্রুতি দেয়, যা বাংলাদেশের চা শিল্পের জন্য নতুন বাজার উন্মুক্ত করতে পারে।
পঞ্চমত, ফল, চিনি ও খাদ্য পণ্যে সহযোগিতা প্রসঙ্গে বিশেষ আলোচনা হয়। বিশেষ করে আনারস ও স্থানীয় চিনি উৎপাদনে সহায়তা এবং মধ্যবর্তী খাদ্যপণ্য যৌথভাবে উৎপাদনের বিষয়ে উভয় দেশ আগ্রহ প্রকাশ করে।
ভিসা সহজীকরণ ও যোগাযোগ বৃদ্ধি
সফরের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অর্জন ছিল ভিসা সহজীকরণ। বৈঠকের পর প্রকাশিত যৌথ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, সরকারি ও কূটনৈতিক পাসপোর্টধারীরা পরস্পর দেশে ভিসা ছাড়াই পাঁচ বছর পর্যন্ত ভ্রমণ করতে পারবেন। এই সিদ্ধান্ত কেবল কূটনৈতিক সম্পর্কই নয়, দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ও রাজনৈতিক যোগাযোগকেও সহজ করবে বলে আশা করা হচ্ছে।

মনোভাব ও আঞ্চলিক প্রভাব
তবে এই নতুন সম্পর্ককে ঘিরে বাংলাদেশে ভিন্নমতও রয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস এখনও অনেকের মনে বেদনাদায়ক স্মৃতি হিসেবে বিদ্যমান। ফলে কিছু মুক্তিযোদ্ধা ও বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব এই সম্পর্ককে সতর্ক দৃষ্টিতে দেখছেন।
অন্যদিকে ভারতও এই উন্নয়ন পর্যবেক্ষণ করছে। কারণ, এটি দক্ষিণ এশিয়ার শক্তি ভারসাম্যে নতুন কৌশলগত পরিবর্তনের ইঙ্গিত বহন করছে। পাকিস্তান ও বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠতা আঞ্চলিক শক্তির সমীকরণে প্রভাব ফেলতে পারে, যা ভারতের কূটনৈতিক কৌশলের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করবে।
সব মিলিয়ে সফরে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ও অঙ্গীকার উঠে এসেছে। শিল্প ও বাণিজ্য খাতে নতুন সহযোগিতা গড়ে তোলার পথ সুগম হয়েছে। দীর্ঘদিন স্থবির হয়ে থাকা JEC পুনরুজ্জীবনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে এবং একটি নতুন বাণিজ্য ও বিনিয়োগ কমিশন গঠনের ঘোষণা এসেছে। হাইড্রোজেন পারঅক্সাইডে অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্ক প্রত্যাহার এবং ১০ মিলিয়ন কেজি শুল্কমুক্ত চা রপ্তানির প্রতিশ্রুতি সফরের অন্যতম বড় সাফল্য হিসেবে দেখা হচ্ছে। এছাড়া ফল, চিনি ও খাদ্য পণ্যে যৌথ উদ্যোগ নেওয়ার বিষয়ে দু’পক্ষই আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
ভিসা সহজীকরণের মাধ্যমে আগামী পাঁচ বছর সরকারি ও কূটনৈতিক স্তরে ভ্রমণ আরও সহজ হবে, যা কূটনৈতিক সম্পর্কের উন্নতিতে সহায়ক ভূমিকা রাখবে। যদিও ইতিহাসের ক্ষত ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি অনেককে সতর্ক থাকতে বাধ্য করছে, তবু কৌশলগত পুনরুদ্ধারের লক্ষণও এই সফরে দৃশ্যমান হয়েছে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















