রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সম্ভাব্য সম্মেলনের প্রেক্ষিতে, ইউক্রেনকে নিরাপত্তা নিশ্চয়তা দেওয়ার বিষয়টি শান্তি আলোচনার কেন্দ্রীয় ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। রাশিয়ার পরামর্শ অনুযায়ী, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যরা, যার মধ্যে রয়েছে চীন, ইউক্রেনের নিরাপত্তা গ্যারান্টরের ভূমিকায় আনার প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে বিশ্লেষকদের মতে, চীনের পক্ষ থেকে বাস্তব কোনো নিরাপত্তা নিশ্চয়তা দেওয়া সম্ভব নয়—উৎস, পূর্ব অভিজ্ঞতা ও নজিরের কারণে।
চীনের অবস্থান—সার্বিক বিশ্লেষণ
- উৎস ও প্রস্তুতির সীমাবদ্ধতা
হরাইজন ইনসাইটস সেন্টারের ডিরেক্টর ঝু ঝুনওয়ে উল্লেখ করেছেন, চীন ভবিষ্যতে ইউক্রেনের নিরাপত্তা গ্যারান্টিতে উচ্চ পর্যায়ে যুক্ত হবে, এমন আশা রাখা উচিত নয়। তিনি ‘নিরাপত্তা গ্যারান্টি’ কী অর্থে বোঝানো হচ্ছে তা স্পষ্ট নয় বলেও উল্লেখ করেছেন। বিশেষভাবে ১৯৯৪ সালের বুদাপেস্ট স্মারকচুক্তির উদাহরণ দিয়েছেন, যেখানে কার্যকারিতা না থাকাই প্রধান সমস্যা ছিল। - ১৯৯৪ সালের বুদাপেস্ট স্মারকচুক্তির সমালোচনা
সেই বছরের ঐ স্মারকচুক্তিতে রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য ইউক্রেনকে পারমাণবিক অস্ত্র ত্যাগের বিনিময়ে নিরাপত্তা নিশ্চয়তা দিয়েছিল। তবে রাশিয়ার ক্রীমিয়া দখল (২০১৪) ও ইউক্রেন আক্রমণ প্রমাণ করে এই নিশ্চয়তাগুলো কার্যকর হয়নি। চীন যদিও কিছু দপ্তরীয় আশ্বাস দিয়েছিল, তা ছিল শর্তসাপেক্ষ এবং সীমিত—অন্য কোনো আক্রমণ থেকে রক্ষা করার বিষয়ে স্পষ্ট প্রতিশ্রুতি ছিল না। - চীনের বর্তমান শর্ত ও আচরণ
ঝু বলেন, বর্তমান পরিস্থিতি পুরোনোর থেকে ভিন্ন—চীন পশ্চিমা গ্যারান্টিগুলোর অংশ হয়ে ওঠার বদলে আলাদা নথিতে রাজনৈতিক বা কূটনৈতিক বক্তব্য প্রকাশ করতে পারে। এছাড়া, জাতিসংঘের আওতায় নিরাপত্তা ব্যবস্থায় অংশ হতে পারে, কিন্তু আজ পর্যন্ত এ ধরনের কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি।

- চীন কেবল ঘোষণা বা সাক্ষী পক্ষ হতে পারে
তসিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা ও কৌশল কেন্দ্রে ফেলো সাং বো মন্তব্য করেছেন, রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র—দুটি শক্তিই চীনকে যুক্ত করার কথা বলছে, কারণ উভয়ের নিজস্ব প্রভাব কমে গেছে। তবে চীন কেবল রাজনৈতিক বা কূটনৈতিক শুভবাক্য বা সাক্ষী ধরনের ভূমিকা পালন করবে, ‘সত্যিকার নিরাপত্তা গ্যারান্টর’ হিসেবে নয়। - সরাসরি অংশগ্রহণে অনীহা—জিন কানরং-এর মন্তব্য
রেনমিন বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক জিন কানরং বলেছেন, ইউক্রেনে সরাসরি যুক্ত হওয়া চীনের স্বার্থে নয়—কারণ ইউরোপ তাদের জন্য প্রতিষ্ঠানগত বা ভৌগোলিকভাবে খুবই দূরবর্তী। চীন চুক্তিনির্ভর শান্তির পক্ষে থাকলেও, সরাসরি গ্যারান্টর বা পক্ষ নেওয়ার প্রবণতা নেই। - চীনের সরকারি প্রতিক্রিয়া—মাও নিং
চীনের পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র মাও নিং বলেছেন, চীন “নিজস্ব উপায়ে সংলাপ ও মধ্যস্থতা অব্যাহত রাখবে” এবং রাজনৈতিক সমাধান প্রচার করবে। - আর্থ-রাজনৈতিক স্বার্থ ও স্থিতিশীলতা
হার্ভার্ড কেনেডি স্কুলের রানা মিটার মনে করেন, চীন সম্ভবত ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে অস্ত্রবিরতি চাইবে, কারণ যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে স্থিতিশীলতা বজায় রাখা চীনের জন্য সুবিধাজনক। ইউরোপ চীনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বাজার এবং সেখানে প্রযুক্তি ও বিনিয়োগ জড়িত—ঐ অঞ্চলের অস্থিরতা চীনের স্বার্থের অনুকূল নয়।

ইউক্রেন ও পশ্চিমা বিকল্প
- জেলেনস্কির বক্তব্য
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি চীনের কোনো অনিহুক গ্যারান্টর হিসেবে অন্তর্ভুক্তিকে অগ্রাহ্য করেছেন। তাঁর ভাষ্য—“যারা প্রয়োজনের সময় ইউক্রেনের পাশে ছিল না, তারা গ্যারান্টর হিসেবে যুক্ত হতে পারে না।” - পশ্চিমা ‘গ্যারান্টি’ আলোচনা ও সম্ভাব্য কাঠামো
ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের কিছু দেশ ইউক্রেনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে একটি ‘নেটো-স্টাইল’ বা যৌথ প্রতিরক্ষামূলক অঙ্গীকার বিবেচনা করছে। তবে কার্যকর ক্ষমতা ও বাস্তব প্রস্তুতির দিক থেকে চীন সেই ধরনের কোনো অঙ্গীকারে যোগ দেওয়ার সম্ভাবনা নেই। - রুশ প্রতিক্রিয়া ও উন্নয়ন
রাশিয়া বলেছে, ইউক্রেনের নিরাপত্তা সংক্রান্ত যে আলোচনা হচ্ছে—সেগুলোতে রাশিয়া অনুপস্থিত থাকলে “সেগুলো কোথাও পৌঁছাবে না”। রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্পষ্ট করে বলেছেন, ইউক্রেনের নিরাপত্তা গ্যারান্টিতে চীনসহ জাতিসংঘের স্থায়ী সদস্যদের যুক্ত থাকা প্রয়োজন। এটি মূল আলোচনাকে জটিল করেছে, কারণ ইউক্রেন ও পশ্চিমা নেতারা রাশিয়ার অংশগ্রহণে আপত্তি তুলছেন।
- চীন বাস্তব নিরাপত্তা গ্যারান্টর হিসেবে ইউক্রেনে সরাসরি অংশ নেওয়ার সম্ভাবনা কম—কারণ এর জন্য প্রয়োজনীয় উৎস, সুস্পষ্ট কৌশল এবং রাজনৈতিক স্বার্থ অনুপস্থিত।
- চীন সম্ভবত রাজনৈতিক সমর্থন, মধ্যস্থতা বা প্রতিশ্রুতিপত্র–ধরণের মাধ্যম বেছে নেবে।
- ইউক্রেন এবং পশ্চিমা পক্ষ থেকে এ জাতীয় দেশগুলোকে অন্তর্ভুক্তির বিরোধিতা করা হতে পারে, যারা সংকটকালে ইউক্রেনের পাশে দাঁড়ায়নি।
- রাশিয়াও চীনের নাম উল্লেখ করে আলোচনায় অংশ নিতে চাইছে, যা আলোচনাকে আরও জটিল করছে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















