নরওয়ের প্রায় দুই ট্রিলিয়ন ডলারের সার্বভৌম সম্পদ তহবিল বিশ্বের সবচেয়ে বড় সরকারি বিনিয়োগ তহবিল। এতদিন এটি শান্ত, কম আলোচিত এক আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত ছিল। কিন্তু আসন্ন ৮ সেপ্টেম্বর তারিখের জাতীয় নির্বাচন ঘিরে এই তহবিলকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছে ব্যাপক রাজনৈতিক বিতর্ক। মূল প্রশ্ন হলো—ইসরায়েলি কোম্পানিগুলোতে বিনিয়োগ অব্যাহত রাখা উচিত কি না, বিশেষ করে গাজায় চলমান যুদ্ধে ইসরায়েলের ভূমিকার প্রেক্ষিতে।
নির্বাচনী বিতর্কের কেন্দ্রে তহবিল
নরওয়ের নির্বাচনী লড়াইয়ে এখন ইসরায়েল ইস্যুই মূল বিতর্কে উঠে এসেছে। সোশ্যালিস্ট লেফট পার্টি স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, তারা ভবিষ্যতের লেবার পার্টি নেতৃত্বাধীন সরকারকে সমর্থন দেবে কেবল তখনই, যদি এই তহবিল ইসরায়েলি কোম্পানি থেকে পুরোপুরি বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে। তাদের ভাষায়, ‘গাজায় ইসরায়েলের অবৈধ যুদ্ধ’ থেকে আর্থিক মুনাফা নেওয়া নরওয়ের জন্য গ্রহণযোগ্য নয়।
লেবার পার্টি প্রথমে এই দাবি প্রত্যাখ্যান করেছে। তবে রাজনৈতিক বাস্তবতায় নির্বাচনের পর এই দাবির মুখোমুখি হলে তাদের জন্য তা সামলানো কঠিন হয়ে উঠতে পারে। ডানপন্থী কনজারভেটিভ, প্রগতি পার্টি, লিবারেল এবং ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাট পার্টিগুলো আপাতত সংখ্যাগরিষ্ঠতার দৌড়ে এগিয়ে আছে। তাই এই বিতর্ক যে সরকার গঠনের সমীকরণে বড় ভূমিকা রাখবে, তা স্পষ্ট।
তহবিলের প্রধানের স্বীকারোক্তি: “সবচেয়ে বড় সংকট”
তহবিলের প্রধান নির্বাহী নিকোলাই ট্যাঙ্গেন প্রকাশ্যে স্বীকার করেছেন, “এটাই আমার জীবনের সবচেয়ে ভয়াবহ সংকট।” তাঁর ভাষায়, বিষয়টি শুধু অর্থনৈতিক নয়, এটি সরাসরি তহবিলের প্রতি জনবিশ্বাসকে প্রশ্নের মুখে ফেলছে।
তিনি পদত্যাগের সম্ভাবনা নাকচ করে বলেছেন, সংসদ যে ম্যান্ডেট দিয়েছে, তিনি তার অনুসারে কাজ করেছেন। তবে ইসরায়েলি কোম্পানিতে বিনিয়োগ এবং তা প্রত্যাহার নিয়ে জনসমালোচনা তীব্র আকার নিয়েছে।
ইসরায়েলি বিনিয়োগ প্রত্যাহারের ধারা
৩০ জুনের পর থেকে তহবিল ইতিমধ্যেই ২৩টি ইসরায়েলি কোম্পানি থেকে বিনিয়োগ প্রত্যাহার করেছে।
যুদ্ধের আগে কেবল দুটি কোম্পানি থেকে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।
১৪ আগস্ট পর্যন্ত তথ্য অনুযায়ী, তহবিল এখনো ৩৮টি ইসরায়েলি কোম্পানিতে প্রায় ১৯ বিলিয়ন নরওয়ের ক্রোন (প্রায় ১.৮৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার) বিনিয়োগ করে রেখেছে। এগুলো মূলত ব্যাংকিং, প্রযুক্তি, ভোগ্যপণ্য ও শিল্প খাতে।
নরওয়ের অর্থমন্ত্রী ইয়েন্স স্টলটেনবার্গ জানিয়েছেন, আরও কোম্পানিতে বিনিয়োগ প্রত্যাহারের প্রক্রিয়া চলছে।
নৈতিকতা বনাম রাজনৈতিক ব্যাখ্যার ঝুঁকি
তহবিলের বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নৈতিক নির্দেশিকা বিদ্যমান। ২০০৪ সাল থেকে এটি কার্যকর আছে, যার মধ্যে বলা হয়েছে যুদ্ধ বা সংঘাতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে যুক্ত কোনো প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করা যাবে না।
তবে সমস্যা হলো, নির্দিষ্ট কোনো দেশকে আলাদা করে লক্ষ্যবস্তু করা হলে সেটি রাজনৈতিক অবস্থান হিসেবে দেখা হতে পারে। বিশেষত রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানির ক্ষেত্রে বিনিয়োগ প্রত্যাহার সরাসরি সেই দেশের সরকারের সমালোচনা হিসেবে ব্যাখ্যা হতে পারে।
এ কারণে প্রশাসনিক পর্যায়ে নৈতিকতার ভারসাম্য রক্ষা করতে গিয়ে তহবিলকে প্রায়শই রাজনৈতিক চাপে পড়তে হচ্ছে।
তহবিলের আর্থিক গুরুত্ব
নরওয়ের এই তহবিল মূলত দেশের তেল ও গ্যাস আয়ের অর্থ বিদেশে বিনিয়োগ করে। এর উদ্দেশ্য হলো, অতিরিক্ত অর্থপ্রবাহে স্থানীয় অর্থনীতি যাতে অতিরিক্ত উত্তপ্ত না হয়ে যায়। বর্তমানে এর আকার প্রায় দুই ট্রিলিয়ন ডলার—প্রতি নাগরিকের হিসাবে প্রায় ৩৫৫,০০০ ডলার সমপরিমাণ।
প্রায় ৯ হাজার কোম্পানিতে বিশ্বজুড়ে বিনিয়োগ রয়েছে এই তহবিলের। এত বড় আকারের কারণে এটি একদিকে যেমন আন্তর্জাতিক আর্থিক বাজারে প্রভাবশালী, অন্যদিকে এর প্রতিটি সিদ্ধান্ত রাজনৈতিকভাবে আলোচিত হয়।
পার্লামেন্টারি সমন্বয়ের প্রথা
সাধারণত নরওয়ের চারটি বড় দল মিলে এক ধরনের “সুপারমেজরিটি” তৈরি করে, যাতে সরকারের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তহবিলের নীতি না বদলায়। এর ফলে তহবিল দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে পারে।
কিন্তু ইসরায়েল ইস্যুতে এই প্রথা ভেঙে রাজনৈতিক বিভাজন প্রকট হয়েছে। কনজারভেটিভ পার্টির সংসদ সদস্য মাহমুদ ফারাহমান্ড বলেছেন, “তহবিল যত বেশি আলোচিত হবে, এর আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তির ঝুঁকি তত বাড়বে।”
সংসদীয় তীব্র সমালোচনা
অর্থমন্ত্রী ইয়েন্স স্টলটেনবার্গ সংসদের তত্ত্বাবধায়ক কমিটির কাছে দেওয়া জবাবে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছেন। কমিটির প্রধান পিটার ফ্রোলিশ একে বলেছেন, ‘চার বছরে আমি সবচেয়ে অহংকারী জবাব পড়েছি’।
তাঁর অভিযোগ, অর্থমন্ত্রী বাস্তব প্রশ্নের জবাব না দিয়ে দীর্ঘ বক্তৃতা দিয়েছেন। এই পরিস্থিতি দেখাচ্ছে, ইস্যুটি কেবল আর্থিক বা নৈতিক নয়—এটি এখন প্রশাসনিক দায়বদ্ধতার প্রশ্নে রূপ নিয়েছে।
ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ
সাবেক অর্থমন্ত্রী ক্রিস্টিন হালভারসেন বলেছেন, “এই তহবিলের প্রতি জনগণের সমর্থন নির্ভর করে এর নৈতিক নীতি অনুসরণের ওপর। মানুষ যদি মনে করে অর্থ সঠিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে না, তাহলে সমর্থন কমে যাবে।”
সাবেক প্রধানমন্ত্রী এরনা সলবার্গও বলেছেন, বিনিয়োগকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখা দীর্ঘদিনের অঙ্গীকার।
তবে বর্তমান অর্থমন্ত্রী মনে করেন, এমন চ্যালেঞ্জ নতুন কিছু নয়। তিনি বলেছেন, “গত ৩০ বছরে আমরা এমন কিছু করেছি, যা আর কোনো দেশ করতে পারেনি—প্রাকৃতিক সম্পদ থেকে আয় নিয়ে সব সঞ্চয় করেছি, আর শুধু আর্থিক লাভ ব্যবহার করেছি।”
নরওয়ের সার্বভৌম সম্পদ তহবিল এখন এক ঐতিহাসিক মোড়ে দাঁড়িয়ে। ইসরায়েলি বিনিয়োগ নিয়ে তৈরি হওয়া বিতর্ক শুধু নির্বাচনের রাজনীতিই নয়, বরং তহবিলের ভবিষ্যৎ নৈতিক অবস্থান ও আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তিকেও প্রভাবিত করবে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় তহবিলের এই সংকট কেবল নরওয়ের নয়, বরং বৈশ্বিক অর্থনীতি ও রাজনীতির জন্যও একটি শিক্ষণীয় অধ্যায়।
নরওয়ের বিশাল তহবিল ও ইসরায়েলি বিনিয়োগ নিয়ে নির্বাচনী বিতর্ক
-
Sarakhon Report - ০১:০৯:০২ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৪ অগাস্ট ২০২৫
- 37
জনপ্রিয় সংবাদ




















