কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ১৯১৪ সালে সাহিত্য পরিষদে রামেন্দ্র সুন্দর ত্রিবেদীর সংবর্ধনার অভিনন্দনে লিখেছিলেন,
‘সর্বজ্জনপ্রিয় তুমি, মাধুর্য্যধারায় তোমার বন্ধুগণের চিত্ত-লোক অভিষিক্ত করিয়াছ। তোমার হৃদয় সুন্দর, তোমার বাক্য সুন্দর, তোমার হাস্য সুন্দর, হে রামেন্দ্রসুন্দর, আমি তোমাকে সাদর অভিনন্দন করিতেছি।’
রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী লোকান্তরে যাবার কিছুদিন আগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘নাইট’ উপাধি ত্যাগ করেন। সেই পদত্যাগ পত্রের বাংলা অনুবাদ বসুমতিতে প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু রামেন্দ্রসুন্দর মহাশয় মূলপত্রটি রবীন্দ্রনাথের নিজের মুখে শোনার বাসনা জানিয়ে ছিলেন গুরুদেবকে, সেই অনুরোধ গুরুদেব রাখেন এবং তিনি সেটি পাঠ করে শোনান, এটিই তার শেষ শ্রবণ। বাঙালির ইতিহাসে এটি একটি অন্যতম সমাপতন। রবীন্দ্রনাথ যদি বাংলাভাষার বটগাছ হন, নিঃসন্দেহে গাছটির প্রধান প্রশাখার একটির নাম রামেন্দ্র সুন্দর ত্রিবেদী।
তৎকালীন উত্তররাঢ়ীয় কায়স্থ সমাজের প্রধান কেন্দ্র জেমোকান্দি গ্রামে ১৮৬৪ সালের ২২শে অগাস্ট তিনি জন্মগ্রহণ করেন । এই বছর তাঁর ১৬২ তম জন্মবার্ষিকী। বাংলা ভাষার ব্যাপ্তিতে তাঁর যে অবদান বাঙালি যদি অকৃতজ্ঞ না হয় তাহলে বঙ্গদেশ এবং বাংলা সাহিত্যে সঙ্গে রামেন্দ্র সুন্দর এর নাম কালের অক্ষয়পটে লেখা থাকবে।
হাতে খড়ি দেবার পর তিনি গ্রামের স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন। ছাত্রবৃত্তি পরীক্ষায় তিনি জেলার মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেন। ইংরাজী শিক্ষার জন্য ভর্তি হয়েছিলেন কান্দি স্কুলে, এই সময় থেকেই তিনি বাংলায় কবিতা লিখতে শুরু করেন। এরপর ১৮৮২ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশিকা পরীক্ষায় সব্বোর্চ স্থান অধিকার করে মাসিক ২৫ টাকা লাভ করেন। এন্ট্রান্স পরীক্ষা দেবার আগেই তিনি গ্রীন, হিউম, গিবনের বড় বড় ইতিহাস পড়ে ফেলেছিলেন। এর পাশাপাশি তিনি ফরাসি দার্শনিক বের্গসর দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে ছিলেন ।
পরবর্তী সময়ে ১৮৮৪ সালে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে প্রথম বি. এ আটর্স অনার্সে দ্বিতীয় এবং ১৮৮৬ সালে বি.এ দ্বিতীয় অনার্সে বিজ্ঞানে প্রথম স্থান অধিকার করে, ৪০ টাকা বৃত্তি পান। এই সময় পেডলার সাহেব তার রসায়নের পরীক্ষক ছিলেন, তাঁর কাজ দেখে তিনি মন্তব্য করেছিলেন ‘out and out the best । ‘ এই সময় থেকেই ‘নবজীবন’ পত্রিকায় বেনামীতে প্রথম প্রবন্ধ লিখতে আরম্ভ করেন। ১৮৮৭ সালে তিনি পদার্থবিদ্যায় এম.এ পরীক্ষা দেন এবং প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হন এবং পরের বছর ১৮৮৮ সালে প্রেমচাঁদ-রায়চাঁদ বৃত্তিলাভ করে। এর পরবর্তী সময় দুবছর তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজের বিজ্ঞানাগারে বিজ্ঞানচর্চা করার জন্য পেডলার সাহেবের কাছ থেকে অনুমতি লাভ করেন।

ত্রিবেদী মহাশয়ের কর্মজীবন শুরু হয় রিপন কলেজ থেকে। ১৮৯২ সালে রিপন কলেজে (বর্তমান নাম শিয়ালদহ সুরেন্দ্রনাথ কলেজ ) বিজ্ঞানের অধ্যাপক হিসেবে এবং পরে আচার্য্য কৃষ্নকমল ভট্টাচার্য্য পদত্যাগ করলে, ১৯০৩ তিনি প্রিসিপালের পদ গ্রহণ করেন এবং শেষ পর্যন্ত ওই পদেই বহাল ছিলেন । তিনি বাংলাভাষায় শিক্ষাদানের পক্ষপাতী ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় গুলিতে তখন বাংলাভাষায় পড়ানোর কোন আনুষ্ঠানিক নিয়ম ছিলনা। পরবর্তী সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতম পরীক্ষা বাংলায় শুরু করা এবং প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত বাংলায় পড়ানোর যে রীতি শুরু হয় তার অন্যতম কান্ডারি তিনি। রামেন্দ্রসুন্দর বাংলা ভাষায় ক্লাসে অধ্যাপনা করতেন। কিন্তু ইংরেজি ভাষাতে পরীক্ষা হবে বলে তিনি বাংলায় বর্ণিত বিষয়গুলো ইংরেজিতে পুনরায় বুজিয়ে দিতেন।
শুধু তাই নয়, তিনি দুবার বিশ্ববিদ্যালয়ে উপদেশক রূপে প্রবন্ধ পাঠ করার জন্য নিমন্ত্রিত হয়ে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন কারণ তিনি বাংলায় প্রবন্ধ পাঠের অনুমতি চেয়েছিলেন কিন্তু তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলায় প্রবন্ধ পড়ার রীতি ছিল না। কিন্তু তৃতীয়বার আমন্ত্রনের সময় তাকে বাংলায় বলার অনুমতি দিলে তিনি বেদ সম্পর্কে বাংলায় প্রবন্ধ পড়েন। এই সময়কালে বাঙালির পরিচ্ছদ ধুতি এবং চাদর পরে কলেজে অধ্যক্ষতা করিতেন। রিপন কলেজে Professors ‘ union ওনার উদোগ্যেই তৈরী হয়।
১৯০৪-১৯০৫ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন নিয়মাবলী প্রস্তুত হবার সময় বাংলাভাষা ও সাহিত্যের পঠন পাঠন এবং পরীক্ষা যাতে বাংলায় হয় তার সমর্থনে রামেন্দ্র সুন্দর একটি বক্তৃতা প্রদান করেন, সেই সময় বাংলার অনেক রথী মহারথীরা ওনার বিরোধিতায় সবর হয়েছিলেন।
শুধুমাত্র শিক্ষা অঙ্গনে নয়, তিনি বাংলা ভাষার ভিত্তি তৈরী এবং তার বিস্তারের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেন । তাঁর শিক্ষা ছিল বিদেশী, কিন্তু দীক্ষা ছিল স্বদেশী। রামেন্দ্র সুন্দর ত্রিবেদীর অন্যতম কৃতিত্ব -একটি সাহিত্য পরিষৎ , একটি সাহিত্য সম্মেলন আর একটি সাহিত্য পরিষদের মন্দির প্রতিষ্ঠা। ১৮৯৪ সালে কলকাতায় বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তিনি অগ্রগণ্য ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। ১৯০৭ সালে রবীন্দ্রনাথের সভাপতিত্বে রামেন্দ্র সুন্দরের চেষ্টায় কাশিমবাজার প্রথম সাহিত্য সম্মেলন হয়।
রামেন্দ্র সুন্দর অনুভব করেছিলেন, দেশকে উন্নত করতে গেলে সর্বপ্রথম দেশীয় ভাষা এবং সাহিত্যের উন্নতি সাধন প্রয়োজন। ইংরাজী ভাষা ও সাহিত্য সুপন্ডিত হয়েও বেশিরভাগ তাঁর রচনা তিনি বাংলাভাষায় লিখেছিলেন। তাঁর দেশাত্মবোধ ও মাতৃভাষার প্রতি অনুরাগ থেকেই বাংলায় তাঁর মূল গবেষণা গ্রন্থগুলি রচনা করেছিলেন।

বাংলা ভাষার ভাষাতত্ত্ব নিয়ে তিনিই প্রথম লেখার চেষ্টা করেছিলেন। তাঁর ধ্বনি-বিচার নামক প্রবন্ধে এ চেষ্টা আমরা দেখতে পাই। তাঁর রচিত গ্রন্থগুলি মধ্যে জনপ্রিয় প্রকৃতি, জিজ্ঞাসা, কর্ম্মকথা, চরিতকথা, শব্দকথা প্রভৃতি। এছাড়া ‘ঐতরেয় ব্রাহ্মণে’র বাংলা অনুবাদ তিনিই করেন।
এছাড়া রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর অন্যতম কৃতিত্ব তিনি মাতৃভাষায় বিজ্ঞান চর্চার ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেছিলেন । তাঁর লেখা প্রকৃতি এবং মায়াপুরী তার সাক্ষ্যি বহন করেন। বঙ্কিমচন্দ্র বিজ্ঞান রহস্যে গোটা কয়েক সন্দর্ভ লিখেছিলেন কিন্তু রামেন্দ্র সুন্দর এর মতো বিজ্ঞানে পণ্ডিত ছিলেন না এবং সায়েন্সের কথা সরল বাংলায় ব্যক্ত করবার শব্দ সম্পদ সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমের ছিল না।
বাংলা শব্দের বৈজ্ঞানিক বিচার তিনিই প্রথম করা শুরু করেন। বৈজ্ঞানিক পরিভাষা স্থির করার জন্য সাহিত্য পরিষদে তার চেষ্টাই শুরু হয় এবং তাঁর সঙ্গে সঙ্গে প্রাচীন বাংলা গ্রন্থের উদ্ধার কার্য চালিয়ে গেছেন। ১৮৯৪ থেকে ১৮৯৯ সালের মধ্যে চারটি পরিভাষা বিষয়ক প্রবন্ধ তিনি প্রকাশ করেন।
তিনি রাজনীতি ঠিক পছন্দ করতেন না, কিন্তু বঙ্গভঙ্গের সময় তিনি অরন্ধন প্রথা প্রচলিত করেছিলেন এবং সেই সময়ের পরিপেক্ষিতে লিখেছিলেন’ বঙ্গলক্ষীর ব্রতকথা । রবীন্দ্রনাথের সহযোগে তিনিই জাতীয় রাখিবন্ধন-উৎসবের অন্যতম উদ্যোগ কর্তা।
কিন্তু এই মহামানব তাঁর জাগতিক জীবন সম্পূর্ণ ভোগ করে যেতে পারেননি, মাত্র ৫৫ বছর বয়েসে ১৯১৯ সালের ৬ই জুন তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন। কিন্তু আজ কত কোটি বাঙালি মানুষ যে প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা বাংলায় পড়তে পারছেন এবং লিখতে পারছেন তার অন্যতম কান্ডারি রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী। শুধু তাই নয় বাংলাকে আধুনিক করে তোলার জন্য যে পরিশ্রম তিনি করেছেন এর মধ্যেই কারো অজান্তে এবং কারো জ্ঞাতসারে তিনি অমরত্ব লাভ করেছেন।
তাপস দাস। সহকারী অধ্যাপক, কান্দি রাজ কলেজ, মুর্শিদাবাদ, ভারত
তাপস দাস 






















