বিশ্বের সবচেয়ে বড় দূষণকারী দেশের সামনে নতুন মুহূর্ত
চীনের ইস্পাত কারখানা, কলকারখানা ও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রতিবছর বিলিয়ন টন কার্বন ডাই–অক্সাইড নিঃসরণ করে। একই সময়ে দেশটি পরিচ্ছন্ন জ্বালানি খাতে ব্যাপক বিনিয়োগ করছে, আর সাম্প্রতিক তথ্য বলছে—চীনের নিঃসরণ ক্রমশ কমছে। আগামী সপ্তাহে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে নিউইয়র্কে চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াং নতুন জলবায়ু প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করতে পারেন। নভেম্বর মাসে ব্রাজিলে অনুষ্ঠিতব্য কপ৩০ সম্মেলনের আগেই এই ঘোষণাকে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক প্রত্যাশা বনাম চীনের বাস্তবতা
প্রধান প্রশ্ন হলো, লি কিয়াং কি নিঃসরণ হ্রাসের গতি বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দেবেন? ২০১৫ সালের প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী, ১৯৫টি দেশ প্রতি পাঁচ বছর অন্তর তাদের জলবায়ু লক্ষ্য হালনাগাদ করার কথা। এগুলোকে বলা হয় ‘ন্যাশনালি ডিটারমাইন্ড কন্ট্রিবিউশন’ (এনডিসি)। চীনের লক্ষ্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ গত বছর দেশটি জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানো থেকে ১২.৬ বিলিয়ন টন কার্বন ডাই–অক্সাইড নিঃসরণ করেছে, যা বিশ্বের মোট নিঃসরণের এক-তৃতীয়াংশ। তবে বিশ্লেষকদের প্রত্যাশা তুলনামূলকভাবে কম। চীন অতীতে ছোট লক্ষ্য ঘোষণা করলেও বাস্তবে বড় সাফল্য দেখিয়েছে।
২০২০ সালের লক্ষ্য ও বর্তমান চিত্র
২০২০ সালে চীন ঘোষণা করেছিল, ২০৩০ সালের মধ্যে তারা কার্বন নিঃসরণ সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে গিয়ে তারপর কমাবে। এছাড়া জীবাশ্ম জ্বালানির অংশ কমানো এবং জিডিপি অনুপাতে কার্বন উৎপাদন হ্রাসের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। বাস্তবে, ২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসে নিঃসরণ আগের বছরের তুলনায় ১% কমেছে। তবে ‘কার্বন ইন্টেনসিটি’ হ্রাসে চীন পিছিয়ে আছে।
নতুন এনডিসিতে কী আসতে পারে
এইবার চীন প্রতিশ্রুতির পরিধি বাড়াচ্ছে। শুধু কার্বন ডাই–অক্সাইড নয়, কয়লাখনি ও ধানক্ষেত থেকে নির্গত মিথেনসহ অন্যান্য গ্রিনহাউস গ্যাসও অন্তর্ভুক্ত হবে। সিমেন্ট ও ইস্পাতসহ ভারী শিল্পকেও কোনো না কোনোভাবে লক্ষ্যভুক্ত করা হবে। তবে কূটনীতিকেরা ভাষার সূক্ষ্ম ব্যবহারে নজর রাখবেন—চীন যদি বলে ‘হ্রাস করা’, তা এক অর্থ; আর যদি বলে ‘প্রচেষ্টা চালানো’, তার অর্থ ভিন্ন।
বৈশ্বিক তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের হিসাব
প্যারিস চুক্তির লক্ষ্য পূরণে চীনের ২০২৫ থেকে ২০৩৫ সালের মধ্যে অন্তত ২০% নিঃসরণ কমানো প্রয়োজন। ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস সীমায় থাকতে চাইলে তা ৩০% পর্যন্ত নামাতে হবে। কিন্তু বিশ্লেষকরা মনে করছেন, চীন হয়তো সর্বোচ্চ ১৫% হ্রাসের প্রতিশ্রুতি দেবে, এমনকি তা ১০%এরও কম হতে পারে। এতে আন্তর্জাতিক প্রত্যাশা ও চীনের বাস্তব প্রতিশ্রুতির মধ্যে ফারাক থেকেই যাবে।
রাজনীতি ও জ্বালানি নিরাপত্তার অজুহাত
চীন নিজেকে এখনও উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে উপস্থাপন করে। তাদের মতে, জলবায়ু সমস্যার মূল দায় পশ্চিমাদের, তাই সমাধানে সাহসী পদক্ষেপ নেওয়ার দায়িত্বও পশ্চিমাদের। তাছাড়া ইউরোপে জলবায়ু কর্মসূচিতে আগ্রহ কমছে এবং এ বছর আমেরিকা প্যারিস চুক্তি থেকে বেরিয়ে গেছে। এর ফলে চীনের ওপর চাপ আরও কমেছে।
অন্যদিকে, জ্বালানি নিরাপত্তা চীনের জন্য বড় বিষয়। বিদ্যুতের প্রায় ৬০% আসে কয়লা থেকে। নীতি-নির্ধারকেরা আশঙ্কা করছেন, দ্রুত কয়লা বাদ দিলে বিদ্যুৎ গ্রিড ভেঙে পড়তে পারে এবং শিল্প উৎপাদন ব্যাহত হতে পারে। তাই তারা “অতিরিক্ত কয়লা সক্ষমতা” ধরে রাখতে চাইছে। শুধু গত বছরই চীন প্রায় ১০০ গিগাওয়াট নতুন কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ শুরু করেছে।
ক্লিনটেক শিল্পের উত্থান
চীনের নিরুৎসাহিত প্রতিশ্রুতির বিপরীতে এক বড় ইতিবাচক দিক হলো ক্লিনটেক খাতের অগ্রগতি। রাষ্ট্রীয় সহায়তা, বৃহৎ উৎপাদন ক্ষমতা ও প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের কারণে দেশটি নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে রেকর্ড স্থাপন করেছে। ২০২০ সালে নির্ধারিত ২০৩০ সালের মধ্যে ১,২০০ গিগাওয়াট সৌর ও বায়ুশক্তি স্থাপনের লক্ষ্য ইতিমধ্যেই পূর্ণ হয়েছে—ছয় বছর আগেই। শুধু ২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসেই চীন ২৫৬ গিগাওয়াট সৌরশক্তি সংযোজন করেছে, যা বিশ্বের বাকি সব দেশের মিলিত সংযোজনের দ্বিগুণ।
অর্থনীতির নতুন ভরকেন্দ্র
সৌরশক্তি, বৈদ্যুতিক গাড়ি ও ব্যাটারি শিল্প এখন চীনের জিডিপির প্রায় ১০%। গবেষণা প্রতিষ্ঠান CREA-এর হিসাবে, ২০৩৫ সালের মধ্যে এসব খাতে বিনিয়োগ ও বিক্রি দ্বিগুণ হতে পারে। এতে যেমন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়ছে, তেমনি মধ্যপ্রাচ্যের মতো অস্থিতিশীল অঞ্চল থেকে তেল আমদানির ওপর নির্ভরশীলতা কমছে। বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ৮০% সৌরসেল চীনেই তৈরি হয়।
চীনের জন্য গ্রহের ভবিষ্যতের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো অর্থনীতি ও প্রযুক্তিগত নেতৃত্ব। সিচুয়ান প্রদেশের চেংদু শহরে টংওয়ে নামের এক বৃহৎ সৌরসেল নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের প্রদর্শনীতে যেমন দেখা যায়—তারা জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি স্বীকার করলেও, আসল গর্ব প্রকাশ করে এই বলে যে চীন বিদেশি প্রযুক্তিগত বাধা অতিক্রম করে নেতৃত্ব অর্জন করেছে।
ফলে, চীনের জলবায়ু প্রতিশ্রুতি হয়তো উচ্চাকাঙ্ক্ষী হবে না, কিন্তু তাদের ক্লিনটেক শিল্প এগিয়ে যাচ্ছে অবিশ্বাস্য গতিতে। এ দিকটিই বৈশ্বিক জলবায়ু সংকটে একটুখানি আশার আলো জ্বালায়।