হঠাৎ অভিযানে কোরীয় কর্মীদের আটক
সিউল: যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টাভিত্তিক অভিজ্ঞ আইনজীবী লি জং-হোয়া সম্প্রতি দক্ষিণ কোরিয়ায় থাকা তার সহকর্মী ও বন্ধুদের উদ্বিগ্ন ফোনকল সামলাচ্ছেন। কারণ, চলতি মাসের শুরুতে জর্জিয়ার একটি ব্যাটারি কারখানায় মার্কিন অভিবাসন কর্তৃপক্ষের অভিযানে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রায় ৩০০ কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়।
৪ সেপ্টেম্বর আইসিই (ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট) পরিচালিত অভিযানের ঘটনা স্মরণ করে লি বলেন, “ভাবুন তো, আপনি মিটিংয়ে বসে আছেন, হঠাৎ সশস্ত্র লোক ঢুকে পড়ল, হেলিকপ্টার মাথার উপর ঘুরছে, আর আপনাকে হাত উঁচু করতে হলো।”
লি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “এভাবে একসঙ্গে শত শত লোককে গ্রেপ্তার করল, অথচ বৈধ ভিজিটর আর অবৈধ শ্রমিককে আলাদা করার চেষ্টা পর্যন্ত করল না।”
আইনি লড়াইয়ের প্রস্তুতি
দক্ষিণ কোরিয়া থেকে আসা একজন মার্কিন নাগরিক হিসেবে লি এখন তার ক্ষোভকে আইনি লড়াইয়ে পরিণত করতে চান। তিনি বলছেন, এই অভিযান অবৈধ ছিল এবং এর ফলে দক্ষিণ কোরিয়ার বিনিয়োগকারীরা যুক্তরাষ্ট্রে আস্থা হারাচ্ছেন।
গ্রেপ্তারের ঘটনা ঘটেছে হুন্ডাই মোটর ও এলজি এনার্জি সলিউশনের যৌথ উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত একটি কারখানায়। গ্রেপ্তার হওয়া অধিকাংশ কর্মী এক সপ্তাহের মধ্যেই মুক্তি পেয়ে দেশে ফিরে গেলেও, দক্ষিণ কোরিয়ার অনেকেই এটিকে নিকট মিত্রের পক্ষ থেকে এক ধরনের বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে দেখছেন।
প্রশাসনের দ্বৈত অবস্থান
এই অভিযান ঘটল এমন সময়ে যখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রশাসন অবৈধ অভিবাসীদের দেশ থেকে ফেরত পাঠানোর প্রচেষ্টা জোরদার করছে। একই সঙ্গে তারা বিদেশি বিনিয়োগ বাড়িয়ে দেশীয় কর্মসংস্থান ও উচ্চপ্রযুক্তি শিল্পকে শক্তিশালী করতে চাইছে।
লি এটিকে বৈপরীত্য হিসেবে তুলে ধরেন। তার মতে, “তারা আসলে যাদের প্রয়োজন: সেই প্রকৌশলী ও টেকনিশিয়ানদেরই গ্রেপ্তার করেছে। চাকরি রক্ষার নামে তারা বরং হাজার হাজার নতুন চাকরি সৃষ্টির পথ আটকে দিয়েছে।”
বৈধ ভিসাধারীরাও আক্রান্ত
লি জানান, গ্রেপ্তার হওয়া শতাধিক কর্মী বৈধভাবে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করেছিলেন। কেউ বি-১ বিজনেস ভিসায়, কেউ ভিসা মওকুফ কর্মসূচির আওতায়। এসব ভিসায় সরঞ্জাম স্থাপন, তত্ত্বাবধান ও প্রশিক্ষণ দেওয়ার অনুমতি রয়েছে, যা তারা করছিলেন। সব কর্মীই প্রবেশের সময় অভিবাসন কর্তৃপক্ষের অনুমোদন পেয়েছিলেন।
তিনি জানান, সম্ভাব্য ক্লাস-অ্যাকশন মামলা নিয়ে ভাবা হচ্ছে। এতে অবৈধভাবে আটক রাখার অভিযোগ আনা হতে পারে এবং ক্ষতিপূরণ ও আনুষ্ঠানিক ক্ষমা প্রার্থনার দাবি করা হতে পারে। অবশেষে দক্ষিণ কোরীয় কোম্পানি ও মার্কিন কর্তৃপক্ষের আলোচনার পর কর্মীদের মুক্তি দেওয়া হয়।
প্রতিনিধিত্ব ও ক্ষতিপূরণ
লি বর্তমানে নেলসন মুলিনস নামের একটি আইন সংস্থায় কর্মরত। তিনি জানান, তিনি প্রায় ৩০ জন কর্মীর প্রতিনিধিত্ব করছেন। ক্ষতিপূরণের পরিমাণ নিয়ে মন্তব্য করতে তিনি রাজি হননি।
বিনিয়োগকারীদের আস্থা নষ্ট
ঘটনাটি এমন সময়ে ঘটেছে যখন ট্রাম্প প্রশাসন দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান ও তাইওয়ানের মতো দেশগুলোকে যুক্তরাষ্ট্রে আরও বিনিয়োগে চাপ দিচ্ছে। ইতিমধ্যেই স্যামসাঙ, হুন্ডাই, এসকে এবং এলজি যুক্তরাষ্ট্রে সেমিকন্ডাক্টর থেকে শুরু করে গাড়ি ও ব্যাটারি শিল্পে বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করছে। এর মধ্যে জর্জিয়ার কারখানা অন্যতম বড় প্রকল্প।
কিন্তু এই অভিযানের কারণে যুক্তরাষ্ট্রে বিনিয়োগ নিরাপদ কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। হুন্ডাই মোটরের সিইও হোসে মুনোজ জানিয়েছেন, জর্জিয়ার ব্যাটারি প্রকল্পের নির্মাণকাজ অন্তত দুই থেকে তিন মাস পিছিয়ে গেছে।
আস্থা সংকট কর্মক্ষেত্র ছাড়িয়ে আকাশপথেও
শুধু বোর্ডরুম নয়, প্রভাব পড়েছে যাতায়াতেও। আগে যেখানে সিউল-আটলান্টা ফ্লাইটে সিট পাওয়া কঠিন ছিল, এখন তা অর্ধেক খালি থাকছে।
লি বলেন, “আমার এক ক্লায়েন্ট বলছিলেন, কোরিয়া থেকে আসা ডেল্টা বিমানে তিনি দেখেছেন অর্ধেক আসন খালি। আগে তো সিট পাওয়া যেত না। এখন ব্যবসায়িক বৈঠক কিংবা প্রশিক্ষণের জন্য লোকজন আসতে চাইছে না। তারা ভয় পাচ্ছেন, রাস্তায়, হাইওয়েতে বা কর্মক্ষেত্রে গ্রেপ্তার হতে পারেন। তাই নিশ্চিতভাবে বলা যায়, এই অভিযান বিনিয়োগের পরিবেশকে শীতল করে দিয়েছে।”