মানুষের জীবন ও সংস্কৃতির সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত থাকার জন্য নদী বাংলাদেশের প্রাণ । দেশের প্রতিটি অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রা, অর্থনীতি ও সংস্কৃতি কোনো না কোনো নদীর ওপর নির্ভরশীল। ময়মনসিংহ অঞ্চলের মানুষের জন্য সেই নদী হলো বঙ্গশী নদী। এই নদী শুধু একটি পানিপ্রবাহ নয়, বরং একটি ইতিহাস, একটি ঐতিহ্য এবং এক গভীর মানবিক কাহিনি।
প্রবীণদের ভাষায়: “বঙ্গশী মানে আমাদের জীবন।” অথচ এই নদী আজ সংকটে, ধুঁকছে দখল, দূষণ ও প্রবাহহীনতার কারণে। কেন এমন হলো? কেমন ছিল একসময়ের গৌরব? ভবিষ্যৎ কি এখনও আছে? এই প্রশ্নগুলো নিয়েই আজকের ফিচার।
ভৌগোলিক অবস্থান ও উৎপত্তি: নদীর জন্মকথা
বঙ্গশী নদীর উৎপত্তি হয়েছে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র থেকে। ইতিহাস বলে, কয়েকশ বছর আগে ব্রহ্মপুত্রের প্রবাহ পরিবর্তিত হলে বঙ্গশী একটি শক্তিশালী শাখা নদী হিসেবে জন্ম নেয়। এর প্রবাহ শুরু হয়েছিল ময়মনসিংহের গফরগাঁও অঞ্চলের কাছাকাছি, পরে তা ফুলবাড়িয়া, ভালুকা হয়ে টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ অতিক্রম করে ধলেশ্বরীর সাথে মিলিত হয়।
দৈর্ঘ্য প্রায় হলেও এখন নদীর প্রস্থ অনেক জায়গায় পঞ্চাশ থেকে ষাট মিটারে এসে দাঁড়িয়েছে। অথচ একসময় নদীটি ছিল শত শত মিটার প্রশস্ত। প্রাকৃতিক প্রবাহ ও বর্ষার স্রোত ময়মনসিংহ অঞ্চলের কৃষি ও পরিবেশে প্রাণ এনে দিত।
ইতিহাস ও ঐতিহ্য: বাণিজ্যপথের উজ্জ্বল স্মৃতি
সপ্তদশ থেকে উনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত বঙ্গশী নদী ছিল উত্তর-মধ্যাঞ্চলের বাণিজ্যের প্রধান রুট। ব্রিটিশ আমলে এই নদীপথ দিয়ে ধান, পাট, আখ, গুড়, কাঠ, চুনাপাথর, বালি, এমনকি লবণও পরিবহন করা হতো।
ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের হাটবাজারে পণ্য পাঠাতে ব্যবসায়ীরা এই নদীর ওপরই নির্ভর করতেন। গফরগাঁও, ফুলবাড়িয়া ও আশপাশের হাটবাজার ছিল নদীকেন্দ্রিক। প্রবীণ বাসিন্দাদের মতে:
“নদী ছাড়া তখন জীবনই ভাবা যেত না। সকাল থেকে রাত অবধি পালতোলা নৌকা, পণ্যবাহী বড় লঞ্চে নদী সরগরম থাকত।”
কৃষি ও অর্থনীতির সাথে সম্পর্ক: উর্বরতার প্রাণরেখা
নদী মানেই কৃষি। বঙ্গশী নদীর পানি ছিল ময়মনসিংহ অঞ্চলের কৃষকদের সবচেয়ে বড় ভরসা। বর্ষার পানি ফসলি জমিকে সেচ দিত, বন্যার সময় জমা পলি পরবর্তী মৌসুমে উর্বরতা বাড়াত।
বিশেষ করে আমন ধান, পাট ও আখ উৎপাদনে এই নদীর পলিমাটি অপরিহার্য ছিল। সত্তরের দশকে বঙ্গশীর আশপাশে কৃষি উৎপাদন বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় অনেক বেশি হতো। কৃষকেরা বলতেন, “বঙ্গশীর পলিই আমাদের ফসলের প্রাণ।”
অর্থনীতিতেও নদীর বড় ভূমিকা ছিল। শুধু কৃষক নয়, জেলে, মাঝি, নৌকা নির্মাতা, কাঠ ব্যবসায়ী—সবাই জীবিকা নির্বাহ করতেন এই নদীকে ঘিরে।
জীববৈচিত্র্যের ভাণ্ডার: হারিয়ে যাওয়া রূপকথা
বঙ্গশী একসময় ছিল দেশি মাছের ভাণ্ডার। কৈ, শিং, মাগুর, টেংরা, বোয়াল, শোল, পাবদা, গজার, এমনকি শীতকালে ইলিশও ধরা পড়ত। নদীর জলে ছিল প্রচুর শাপলা, শালুক, পানিফল ও জলজ উদ্ভিদ।
শীতকালে আসত অতিথি পাখি। তীর জুড়ে ছিল কাশফুল আর পানির ওপর ভেসে থাকত সাদা ও লাল শাপলা। গ্রামীণ মানুষের বিনোদন, খাবার ও প্রকৃতির সৌন্দর্য সবই ছিল এই নদীর সঙ্গে জড়িত।
আজ তা প্রায় হারিয়ে গেছে। প্রবাহ কমে যাওয়া ও দূষণের কারণে মাছের প্রজাতি বিলুপ্ত, পাখির আগমন বন্ধ। স্থানীয় এক জেলে বলেন,
“আগে দিনে দিনে মাছ ধরতে পারতাম। এখন দিন গড়ালেও এক কেজি পাই না।”
সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব: লোকসংস্কৃতির প্রাণ
বঙ্গশী শুধু কৃষি বা অর্থনীতির সঙ্গে নয়, মানুষের হৃদয় ও সংস্কৃতির সঙ্গেও জড়িত। এখানে নৌকাবাইচ হতো, হাটে-মেলায় জমত পল্লিগীতি, জারি-সারি ও বাউল গান।
ময়মনসিংহ গীতিকার পালাগাথায় নদীর উল্লেখ পাওয়া যায়। কবি-সাহিত্যিকরা নদীকে জীবন, প্রেম ও বেঁচে থাকার প্রতীক হিসেবে লিখেছেন। স্থানীয় প্রবীণ কবির পঙ্ক্তি:
“বঙ্গশীর ঢেউ মানে-ই আমাদের বেঁচে থাকার গান।”
স্থানীয় মানুষের অভিজ্ঞতা: নদীর সঙ্গে সুখ-দুঃখ
গফরগাঁওয়ের জেলে রফিক মিয়া বলেন:
“আমার বাবাও মাছ ধরতেন, আমিও ধরি। কিন্তু নদী তো আগের মতো নেই। মাছ নেই, পানি নেই। আমরা বাধ্য হয়ে অন্য কাজ খুঁজছি।”
অন্যদিকে কৃষক আজিজুল হক জানান, “আগে নদীর পলিতে জমি উর্বর হতো। এখন ভূগর্ভস্থ পানির সেচে ফসল তুলতে হয়। খরচ বেশি, লাভ কম।”
ফুলবাড়িয়ার প্রবীণ আব্দুল কাদের স্মৃতিচারণ করেন,
“যুবক বয়সে এই নদী ছিল আমাদের খেলার মাঠ। নৌকায় পাল তুলে গান গাইতাম। আজ নদী যেন মৃত্যুর দিকে এগোচ্ছে।”
বর্তমান সংকট: ধ্বংসের নীলনকশা
আজকের বঙ্গশী একাধিক সংকটে জর্জরিত:
ভরাট ও দখল: নদীর তীর অবৈধভাবে দখল করে গড়ে উঠেছে বসতবাড়ি, বাজার ও ইটভাটা।
দূষণ: শিল্পবর্জ্য, কৃষিরসায়নিক ও গৃহস্থালি ময়লা প্রতিদিন পড়ছে নদীতে।
প্রবাহহীনতা: ব্রহ্মপুত্র থেকে প্রবাহ বন্ধ হওয়ায় নদী শুকিয়ে যাচ্ছে।
জীববৈচিত্র্যের ধ্বংস: মাছ, উদ্ভিদ ও পাখি প্রায় বিলুপ্ত।
মানবিক সংকট: জেলে ও কৃষকেরা জীবিকা হারাচ্ছেন।
পরিসংখ্যান ও গবেষণালব্ধ তথ্য: সংকটের প্রমাণ
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী:
গত পঞ্চাশ বছরে বঙ্গশীর প্রস্থ চল্লিশ শতাংশ কমেছে।
একসময় বছরে বহু টন মাছ উৎপাদন হতো, এখন তা নেমে এসেছে অল্প পরিমাণে।
মৎস্য অধিদপ্তরের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নদীসংলগ্ন অধিকাংশ জেলে পরিবার এখন দারিদ্র্যসীমার নিচে।
পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনা: বাঁচার শেষ চেষ্টা
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সঠিক পদক্ষেপ নিলে বঙ্গশী আবারও জেগে উঠতে পারে।
পুনঃখনন: নদীর তলদেশ খনন করে প্রবাহ ফিরিয়ে আনা।
দখল উচ্ছেদ: নদীর তীর থেকে অবৈধ স্থাপনা সরিয়ে ফেলা।
দূষণ নিয়ন্ত্রণ: শিল্পবর্জ্য শোধন না করে নদীতে ফেলা যাবে না।
সামাজিক আন্দোলন: নদী বাঁচাতে জনগণকে সংগঠিত করা।
সরকারি উদ্যোগ: দীর্ঘমেয়াদি মাস্টার প্ল্যান নিয়ে কাজ করা।
ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বার্তা
নদী শুধু একটি জলরাশি নয়; বরং মানুষের জীবন ও ইতিহাসের অংশ। বঙ্গশীকে রক্ষা করা মানে ময়মনসিংহের কৃষি, জেলে, ব্যবসা ও সংস্কৃতিকে বাঁচানো। আগামী প্রজন্মকে যদি জীবন্ত নদীর সৌন্দর্য উপহার দিতে চাই, তবে এখনই কাজ শুরু করতে হবে।
বঙ্গশী নদী হলো ময়মনসিংহের আত্মার প্রতীক। আজ এটি সংকটে, কিন্তু সঠিক পদক্ষেপ নিলে আবার জেগে উঠতে পারে। ইতিহাস, অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও জীববৈচিত্র্যের ধারক হলো এই নদী। একে বাঁচানো মানেই মানুষের অস্তিত্ব বাঁচানো।