বাংলাদেশ ব্যাংক গত তিন মাসে নিলামের মাধ্যমে প্রায় ২.১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার কিনেছে—যা অর্থনীতিতে নতুন প্রশ্ন তুলেছে। এই নীতি কি রিজার্ভ পুনরুদ্ধারের কৌশল, নাকি মুদ্রানীতির ভারসাম্য নষ্টের পূর্বাভাস? এই প্রতিবেদনে তুলে ধরা হলো সেই নীতির পটভূমি, উদ্দেশ্য, ঝুঁকি ও সম্ভাবনা।
অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট ও সাম্প্রতিক তথ্য
বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের আগস্টে দেশের মোট বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৩১,১৬৬.২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। তবে “বিপিএম৬” (BPM6) মানদণ্ডে রিজার্ভ দাঁড়ায় ২৬,১৭৩.৭ মিলিয়ন ডলারে, অর্থাৎ আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী হিসাব করলে কিছুটা কম।
২০২৪–২৫ অর্থবছরের বিভিন্ন সময়ে রিজার্ভের পরিমাণ কাছাকাছি সীমায় ওঠানামা করেছে। উদাহরণস্বরূপ, জুন ২০২৫-এ রিজার্ভ ছিল গড়ে ৩১,৭৭২ মিলিয়ন (মোট) এবং ২৬,৭৪০ মিলিয়ন (বিপিএম৬)।
মিডিয়া প্রতিবেদনগুলোতে বলা হয়েছে, রেমিট্যান্স বৃদ্ধি ও নিলাম পদ্ধতিতে ডলার কেনার কারণে রিজার্ভ আবারও ২৬ বিলিয়ন ডলারের সীমা অতিক্রম করেছে।
এই তথ্যগুলো ইঙ্গিত দেয় যে—রিজার্ভ এখনো তুলনামূলক স্থিতিশীল হলেও, দেশের বৈদেশিক দায় পরিশোধ ও আমদানি ব্যয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে এটি যথেষ্ট নয়।
রেমিট্যান্স প্রবণতা
২০২৪–২৫ অর্থবছরে প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স রেকর্ড পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই সময়ে রেমিট্যান্সের প্রবাহ দাঁড়ায় প্রায় ৩০.০৪ বিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় ২৫.৫ শতাংশ বেশি।
ডিসেম্বর থেকে মার্চ ২০২৫ পর্যন্ত কয়েকটি মাসে রেমিট্যান্সের পরিমাণ ছিল রেকর্ড উচ্চতায়—যেমন মার্চে ৩.২৯ বিলিয়ন ডলার। তবে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে প্রবাহে কিছুটা মন্দা দেখা গেছে; জুলাই ২০২৫-এ রেমিট্যান্স কমে দাঁড়ায় ২.৪৭ বিলিয়ন ডলার।
তবুও সেপ্টেম্বরের প্রথম ২২ দিনে রেমিট্যান্স প্রবাহ ছিল প্রায় ২.১ বিলিয়ন ডলার, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৮ শতাংশ বেশি।
অর্থাৎ রেমিট্যান্স প্রবাহ এখনো দৃঢ় রয়েছে, তবে এর ধারাবাহিকতা নির্ভর করছে বৈশ্বিক অর্থনীতি ও অভ্যন্তরীণ নীতির স্থিতিশীলতার ওপর।
মুদ্রানীতি ও হস্তক্ষেপের তত্ত্ব ও অভিজ্ঞতা
হস্তক্ষেপের সংজ্ঞা ও উদ্দেশ্য
বিদেশি মুদ্রা বাজারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তক্ষেপ বলতে বোঝায়—মুদ্রা ক্রয় বা বিক্রয়ের মাধ্যমে বিনিময় হার ও বাজারের অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টা।
এ ধরনের পদক্ষেপ সাধারণত বাজারকে স্থিতিশীল রাখতে, একমুখী ওঠানামা প্রতিরোধ করতে এবং হঠাৎ দামের ধাক্কা প্রশমিত করতে ব্যবহৃত হয়।
হস্তক্ষেপের কার্যকারিতা
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গবেষণা বলছে, স্বল্পমেয়াদে হস্তক্ষেপ কার্যকর হতে পারে, বিশেষ করে তখন, যখন মুদ্রাবাজারে তারল্য কম থাকে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) “সমন্বিত নীতি কাঠামো” নথিতে বলা হয়েছে—হস্তক্ষেপ তখনই উপযুক্ত, যখন বাজারে বড় ধরণের ধাক্কা আসে এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সেই চাপ মোকাবিলার সক্ষমতা থাকে।
হস্তক্ষেপ দুইভাবে হতে পারে:
নিষ্ক্রিয় বা স্টেরিলাইজড হস্তক্ষেপ—যেখানে কেন্দ্রীয় ব্যাংক হস্তক্ষেপের পর অভ্যন্তরীণ অর্থ সরবরাহ নিরপেক্ষ রাখে।
সক্রিয় বা আনস্টেরিলাইজড হস্তক্ষেপ—যেখানে হস্তক্ষেপ সরাসরি মুদ্রার তারল্য ও সুদের হারে প্রভাব ফেলে।
অনেক উন্নয়নশীল অর্থনীতিতে এই হস্তক্ষেপ “নিয়ন্ত্রিত ভাসমান বিনিময় হার” (Managed Float) ব্যবস্থার অংশ হিসেবে চালু থাকে—অর্থাৎ পুরোপুরি বাজারনির্ভর নয়, আবার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রিতও নয়।
তবে গবেষণা ইঙ্গিত দেয়, যখন হস্তক্ষেপ ধারাবাহিক ও একমুখী হয়, তখন এর কার্যকারিতা বেশি দেখা যায়। অন্যদিকে অতিমাত্রায় বড় ও অনিয়মিত হস্তক্ষেপ বাজারে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নিলাম পদ্ধতির বিশ্লেষণ
নিলাম পদ্ধতির ধরন
বাংলাদেশ ব্যাংক এখন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে নিলামের মাধ্যমে ডলার কিনছে। অর্থাৎ, ব্যাংকগুলো তাদের ডলার বিক্রির প্রস্তাব জমা দেয় এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক নির্দিষ্ট কাট-অফ রেট নির্ধারণ করে। এই পদ্ধতি বিদেশি মুদ্রা বাজারে “স্পট মার্কেট হস্তক্ষেপ” হিসেবে বিবেচিত হয়।
এই ব্যবস্থার কিছু বৈশিষ্ট্য হলো:
- এটি তুলনামূলক স্বচ্ছ ও পূর্বাভাসযোগ্য।
- হস্তক্ষেপের পরিমাণ সীমিত ও সময়সীমাবদ্ধ, যাতে বড় ধাক্কা সামলানো যায়।
- প্রয়োজনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই প্রক্রিয়ার প্রভাব কমাতে “নগদ প্রত্যাহার” বা “স্টেরিলাইজেশন” পদ্ধতি ব্যবহার করতে পারে।
হস্তক্ষেপের সম্ভাব্য উদ্দেশ্য
বিনিময় হারের অস্থিরতা কমানো
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি বা রক্ষা করা
রেমিট্যান্স প্রেরক ও রপ্তানিকারকদের স্বার্থ রক্ষা করা
বাজারে স্থিতিশীলতার বার্তা দেওয়া
কাঠামোগত সীমাবদ্ধতা
- অনিয়মিত বা দুর্বল হস্তক্ষেপ বাজার অংশগ্রহণকারীদের অতিনির্ভরশীল করে তুলতে পারে।
- রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে গেলে রিজার্ভে চাপ বাড়তে পারে।
- হস্তক্ষেপের পর সঠিকভাবে অর্থ সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ না করলে মূল্যস্ফীতি বাড়তে পারে।
- দীর্ঘমেয়াদে এই নীতি টেকসই নাও হতে পারে।
নীতিগত সামঞ্জস্য
এই হস্তক্ষেপ “নিয়ন্ত্রিত ভাসমান বিনিময় হার” নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, তবে সফলতার জন্য দরকার—
- মুদ্রানীতি ও সুদের হারের সঙ্গে সমন্বয়
- নীতির স্বচ্ছতা ও পূর্বাভাসযোগ্যতা
- রিজার্ভ ব্যবস্থাপনায় সতর্কতা
সম্ভাব্য ঝুঁকি, সুযোগ ও চ্যালেঞ্জ
ঝুঁকি
রিজার্ভ ক্ষয়—অতিরিক্ত হস্তক্ষেপ রিজার্ভ কমিয়ে দিতে পারে।
বাজারে বিশ্বাসহীনতা—হঠাৎ হস্তক্ষেপ বাজারে সন্দেহ তৈরি করে।
অতিনির্ভরশীলতা—ব্যাংকগুলো ভাবতে পারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সবসময় সাহায্যে আসবে।
অভ্যন্তরীণ নীতির বিকৃতি—মূল্যস্ফীতি ও সুদের হার অস্বাভাবিকভাবে ওঠানামা করতে পারে।
সীমিত প্রভাব—বৃহৎ ও গভীর মুদ্রাবাজারে হস্তক্ষেপের প্রভাব ক্ষীণ হয়।
সুযোগ
মুদ্রা বাজারের অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।
রিজার্ভ পুনরুদ্ধার ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখা যায়।
রপ্তানিকারক ও প্রবাসী আয়ের প্রেরকরা স্থিতিশীল হারে উপকৃত হন।
বাজারে নমনীয়তা ও আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়।
চ্যালেঞ্জ
- হস্তক্ষেপের মাত্রা নির্ধারণ কঠিন।
- স্টেরিলাইজেশনের ব্যয় ও প্রশাসনিক খরচ বেশি।
- নীতি ও বাস্তবায়নে সমন্বয় অপরিহার্য।
- অংশগ্রহণকারীদের প্রত্যাশা সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনা করতে হবে।
নীতি সুপারিশ
স্বচ্ছ নীতি ঘোষণা: কেন্দ্রীয় ব্যাংককে হস্তক্ষেপ নীতির সময়, উদ্দেশ্য ও ফলাফল নিয়মিতভাবে প্রকাশ করতে হবে।
ধারাবাহিক পরিকল্পনা: হঠাৎ নয়, বরং মধ্যমেয়াদি ও নিয়মিত পরিকল্পনা গ্রহণ করা উচিত।
নগদ প্রত্যাহার ব্যবস্থা: হস্তক্ষেপের ফলে তারল্য বাড়লে তা নিয়ন্ত্রণে রাখতে বিশেষ বন্ড বা নগদ প্রত্যাহার প্রক্রিয়া চালু করা দরকার।
মুদ্রানীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য: সুদের হার, নগদ রিজার্ভ ও মূল্যস্ফীতির নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত নীতি গ্রহণ অপরিহার্য।
বাজার গভীরতা বৃদ্ধি: বৈদেশিক মুদ্রা বাজারে অংশগ্রহণকারী ও বিনিময় মাধ্যম বাড়াতে হবে।
জনসচেতনতা ও যোগাযোগ: গণমাধ্যম ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যোগাযোগ বাড়ানো উচিত।
পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা: হস্তক্ষেপের ফলাফল ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে মূল্যায়ন করতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নিলামভিত্তিক ডলার কেনা নীতি একটি “সমন্বিত ও মধ্যপন্থী কৌশল” হিসেবে দেখা যেতে পারে—যেখানে বাজারকে পুরোপুরি মুক্ত রাখা হয়নি, আবার কঠোর নিয়ন্ত্রণও আরোপ করা হয়নি।
এই নীতি কার্যকর হতে পারে যদি তা সীমিত, স্বচ্ছ, এবং ধারাবাহিকভাবে পরিচালিত হয়। তবে দীর্ঘমেয়াদে এটি কোনো স্থায়ী সমাধান নয়।
অর্থনীতিকে শক্ত ভিত্তিতে স্থাপন করতে হলে প্রয়োজন রপ্তানি বৃদ্ধি, বিনিয়োগ সম্প্রসারণ ও বাজার সংস্কার—যা মুদ্রানীতিকে কেবল ভারসাম্যপূর্ণ নয়, টেকসইও করে তুলবে।
#বাংলাদেশব্যাংক #ডলারনিলাম #অর্থনীতি #রিজার্ভ #মুদ্রানীতি #রেমিট্যান্স #সারাক্ষণরিপোর্ট