নির্বাচনের আগে অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট
আর মাত্র এক মাস পর বিহারের জনগণ জানবে, আগামী পাঁচ বছর তাদের ভাগ্যকে গড়বেন কে। ১৪ নভেম্বরের ভোটগণনার ফলাফল হয়তো নির্ধারণ করবে আগামী এক দশকের দিকনির্দেশনা—কারণ বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার প্রায় দুই দশক ধরে রাজ্য পরিচালনা করছেন।
বিহারের মূল চ্যালেঞ্জ হলো কর্মসংস্থান সৃষ্টি। সরকারের ই-শ্রম পোর্টালে এখন পর্যন্ত ৩ কোটি ১৬ লাখ মানুষ কাজের সন্ধানে নিবন্ধিত হয়েছেন—যা উত্তর প্রদেশের পর দ্বিতীয় সর্বাধিক। কাজের সুযোগ না বাড়লে এই বিপুল জনগোষ্ঠীর রাজ্যত্যাগ অব্যাহত থাকবে, ফলে বিহারের নিজস্ব বিনিয়োগের সুফলও রাজ্যের বাইরে চলে যাবে।
বেকারত্বের পরিসংখ্যান ও বাস্তবতা
সরকারের সাম্প্রতিক পিরিয়ডিক লেবার ফোর্স সার্ভে (PLFS) অনুযায়ী, ২০২৫ সালের এপ্রিল–জুন ত্রৈমাসিকে বিহারের বেকারত্বের হার ছিল ৫.২ শতাংশ—যা জাতীয় গড় ৫.৪ শতাংশের চেয়ে সামান্য কম। কিন্তু এই পরিসংখ্যান বিভ্রান্তিকর, কারণ রাজ্যের শ্রম অংশগ্রহণের হার (Labour Force Participation Rate) মাত্র ৪৮.৮ শতাংশ। অর্থাৎ, কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর অর্ধেকেরও কম সক্রিয়ভাবে কাজের সন্ধান করছেন।
১৫–২৯ বছর বয়সী তরুণদের মধ্যে এই হার আরও নিচে নেমে ৩৩.৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে—যা জাতীয় গড় ৪২ শতাংশের তুলনায় অনেক কম এবং দেশে সর্বনিম্ন। ফলে কর্মসংস্থান এখন নির্বাচনী রাজনীতির অন্যতম প্রধান ইস্যুতে পরিণত হয়েছে।
রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি: সরকারি চাকরি সবার ঘরে?
বৃহস্পতিবার আরজেডি (RJD) নেতা তেজস্বী যাদব ঘোষণা করেছেন—তাঁর দল ক্ষমতায় এলে প্রত্যেক পরিবার থেকে অন্তত একজনকে ২০ মাসের মধ্যে সরকারি চাকরি দেওয়ার আইন পাস করা হবে।
কিন্তু প্রশ্ন হলো—এত বিপুল সরকারি চাকরির ভার বহন করার মতো আর্থিক সক্ষমতা কি বিহারের আছে?
রাজ্য অর্থনীতি ও ব্যয়ের চাপ
২০২৫–২৬ অর্থবছরের বাজেটে বিহার সরকার বেতন, পেনশন ও ঋণের সুদ বাবদ ১.১২ লাখ কোটি রুপি ব্যয় ধরেছে—যা মোট রাজস্ব ব্যয়ের প্রায় ৪০ শতাংশ। এই ব্যয় “অপরিহার্য” বা স্থায়ী, যেগুলো স্থগিত রাখা যায় না।
বাজেট বিশ্লেষণকারী সংস্থা PRS Legislative Research জানিয়েছে, বিহারের সংশোধিত বাজেটের হিসাব প্রায়ই বাস্তবতা থেকে বিচ্যুত হয়, যার ফলে রাজস্ব ঘাটতি অনুমোদিত সীমা ছাড়িয়ে যায়। ২০২২–২৩ থেকে ২০২৪–২৫ পর্যন্ত বাজেটকৃত ঘাটতির হার ছিল ৩–৩.৫ শতাংশ, কিন্তু সংশোধিত হিসেবে তা প্রায় ৯ শতাংশে পৌঁছেছে।
‘মহিলা রোজগার’ স্কিম ও ভাতা কর্মসূচি
সরকারি চাকরির প্রতিশ্রুতির পাশাপাশি আরও কিছু জনপ্রিয় প্রকল্প চালু করা হয়েছে। ‘মুখ্যমন্ত্রী মহিলা রোজগার যোজনা’য় ২৫ লাখ নারীকে ১০ হাজার রুপি করে দেওয়া হয়েছে ছোট ব্যবসা শুরু করার জন্য। সফল হলে তাঁরা অতিরিক্ত ২ লাখ রুপি পর্যন্ত পাবেন। নীতীশ কুমার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, পুনর্নির্বাচিত হলে এই কর্মসূচি আরও সম্প্রসারিত করবেন।
তাছাড়া, বেকার স্নাতকদের জন্য মাসিক ১,০০০ রুপির ‘সেলফ-হেল্প অ্যালাউন্স’ দেওয়া হবে, যা সর্বোচ্চ দুই বছর পর্যন্ত চালু থাকবে।
‘ফ্রিবি’ নাকি উন্নয়ন উদ্যোগ?
এই প্রকল্পগুলো ‘ফ্রিবি’ বা নিছক ভোটলাভের উপকরণ কি না তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও, এগুলোর ফলে রাজ্যের রাজস্ব ব্যয় নিঃসন্দেহে বৃদ্ধি পাচ্ছে। কেন্দ্রীয় সরকার যেখানে পুঁজিবিনিয়োগ বাড়াতে আহ্বান জানাচ্ছে, সেখানে বিহারের রাজস্ব ব্যয়ের বৃদ্ধি অর্থনৈতিকভাবে উদ্বেগজনক।
২০২৫–২৬ অর্থবছরে রাজ্যের পুঁজিবিনিয়োগ ধরা হয়েছে মাত্র ৪২,০০০ কোটি রুপি—যা মোট ব্যয়ের মাত্র ১৪ শতাংশ।
দারিদ্র্যের গভীরতা
নীতিআয়োগের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯–২১ মেয়াদে বিহারে বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের হার ছিল দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ—৩৩.৭৬ শতাংশ। আরবিআই-সমর্থিত অর্থনীতিবিদদের হালনাগাদ তথ্য অনুসারে, ২০২২–২৩ সালে শহুরে বিহারে দারিদ্র্যসীমা অতিক্রম করতে মাথাপিছু মাসিক ভোগব্যয় প্রয়োজন ছিল ২,২৭৭ রুপি—যা দেশব্যাপী তৃতীয় সর্বনিম্ন। গ্রামীণ এলাকায় এই হার ছিল ১,৭২৪ রুপি—ষষ্ঠ সর্বনিম্ন।
অগ্রগতি ও সীমাবদ্ধতা
তবে সবকিছুই হতাশার নয়। বিগত দশকে দারিদ্র্য হ্রাসে বিহারের সাফল্য প্রশংসনীয়। গত তিন বছরে রাজ্যের আভ্যন্তরীণ উৎপাদন (GSDP) গড়ে ১১.১ শতাংশ হারে বেড়েছে, যেখানে ভারতের গড় প্রবৃদ্ধি ৭.৮ শতাংশ।
তবে এই উন্নয়ন একটি নিম্নভিত্তি থেকে শুরু হয়েছে—২০২৪–২৫ সালে বিহারের জিএসডিপি ১০ লাখ কোটি রুপির নিচে, যা ভারতের মোট জিডিপির মাত্র ৫ শতাংশ।
শিল্প ও পরিষেবা খাতের সংকট
রাজ্যের অর্থনৈতিক কাঠামো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, পরিষেবা খাতের অবদান হ্রাস পাচ্ছে—২০১৯–২০ সালে যেখানে এটি ছিল ৬১.২ শতাংশ, ২০২৪–২৫ সালে তা নেমে এসেছে ৫৪.৮ শতাংশে। এর বিপরীতে শিল্প খাতের অবদান বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৬.৬ শতাংশে।
যদিও এটি ইতিবাচক ইঙ্গিত দেয়, তবুও ভারতের সামগ্রিক অর্থনৈতিক সাফল্য মূলত পরিষেবা খাতনির্ভর—যা উচ্চ বেতনের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে।
২০২৩–২৪ সালে বিহারে নিবন্ধিত কারখানার সংখ্যা ছিল মাত্র ৩,৩৮৬টি, যা দেশের মোট কারখানার ১.৩ শতাংশ। এই কারখানাগুলোয় কর্মরত শ্রমিকের সংখ্যা ছিল ১.১৭ লাখ—দেশের শিল্পক্ষেত্রের মোট শ্রমিকের মাত্র ০.৭৫ শতাংশ।
বিহারের জনসংখ্যা দেশের মধ্যে তৃতীয় সর্বাধিক, কিন্তু অর্থনৈতিক কার্যক্রমে এর অবদান তুলনামূলকভাবে কম। সরকার যদি কেবল ভাতা বা সরকারি চাকরির প্রতিশ্রুতিতে সীমাবদ্ধ থাকে, তবে রাজ্যের অর্থনৈতিক পুনরুত্থান কঠিন হবে। স্থায়ী সমাধান আসবে কেবল বিনিয়োগ, শিল্পায়ন এবং দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়নের মধ্য দিয়ে।
#বিহার_অর্থনীতি #বেকারত্ব #দারিদ্র্য #নীতীশ_কুমার #ভারত_নির্বাচন #সারাক্ষণ_রিপোর্ট