২০২৪–২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি দৃশ্যত কমে এসেছে। আগস্ট ২০২৪-এর পর থেকে অর্থনৈতিক গতিশীলতার যে ধারা ছিল, তা ধীরে ধীরে মন্থর হয়ে পড়ছে। আন্তর্জাতিক সংস্থা আইএমএফ (IMF), বিশ্বব্যাংক ও এডিবি’র (ADB) সাম্প্রতিক পূর্বাভাসে দেখা যাচ্ছে, প্রবৃদ্ধি এখন ৩.৭৬ থেকে ৩.৮ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ। এই পতনের পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, বিনিয়োগ স্থবিরতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও কঠোর আর্থিক নীতির প্রভাব।
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পতনের সংকেত
২০২৪–২৫ অর্থবছরে (জুলাই ২০২৪ – জুন ২০২৫) বাংলাদেশের অর্থনীতি ধীরগতিতে চলছে। আগস্ট ২০২৪-এর পর থেকে নানা সূচকে দেখা যাচ্ছে অর্থনৈতিক গতিচালনার “ঊর্ধ্বগতি” কমে এসেছে। আন্তর্জাতিক সংস্থা ও সরকারি-বেসরকারি তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, প্রবৃদ্ধির গতি কমার মূল কারণগুলো স্পষ্টভাবে চিহ্নিত হচ্ছে।
আইএমএফ জানিয়েছে, চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৩.৭৬ শতাংশে নেমে আসতে পারে। অন্যদিকে, বিশ্বব্যাংক ও এডিবি-ও তাদের পূর্বাভাসে প্রবৃদ্ধির হার কমিয়ে এনেছে, যা দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক গতিপ্রবাহে একধরনের সতর্ক সংকেত দিচ্ছে।
জিডিপি পূর্বাভাসে আইএমএফ, এডিবি ও বিশ্বব্যাংক
উৎস / সংস্থা | অর্থবছর | জিডিপি বৃদ্ধির পূর্বাভাস | মন্তব্য |
IMF (World Economic Outlook, April 2025) | ২০২৪–২৫ | ৩.৮ % | আইএমএফের “At a Glance” বিভাগে ২০২৫ সালের বাস্তব GDP বৃদ্ধির হার ৩.৮% ধরা হয়েছে |
IMF (সংশোধিত) | ২০২৪–২৫ | ৩.৭৬ % | পরবর্তী আপডেটে আইএমএফ পূর্বাভাস হালকা কমিয়ে ৩.৭৬% করেছে |
ADB | ২০২৪–২৫ | ৩.৯ % | এডিবি মনে করছে প্রবৃদ্ধি সামান্য বেশি হতে পারে |
World Bank | ২০২৪–২৫ | ৩.৩ % | বিশ্বব্যাংক তার পূর্বাভাস কমিয়ে এনে ৩.৩% করেছে |
সরকার / BBS (প্রস্তাবিত) | ২০২৪–২৫ | ৩.৯৭ % | প্রাথমিক সরকারি হিসাব অনুযায়ী বৃদ্ধির হার ৩.৯৭% ধরা হয়েছে |
আগস্ট ২০২৪-এর পর পতনের ধারা: কারণ ও প্রেক্ষাপট
রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও সুশাসনের ঘাটতি
২০২৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে রাজনৈতিক উত্তেজনা ও আন্দোলন-বিক্ষোভ ব্যবসা ও বিনিয়োগের পরিবেশে অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে। সরকার ও নীতিনির্ধারণে পরিবর্তনের আশঙ্কা প্রকল্প বাস্তবায়নে বিলম্ব ঘটিয়েছে, ফলে অর্থনৈতিক কার্যক্রমে স্থবিরতা এসেছে।
বিনিয়োগের হ্রাস
দেশের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বিনিয়োগ উভয়ই কমেছে। আইএমএফ জানায়, “economic disruptions, tightened policy mix, heightened uncertainty”—এসব কারণে বিনিয়োগ ব্যাহত হচ্ছে। দীর্ঘমেয়াদে এটি উৎপাদনশীলতা ও কর্মসংস্থানে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
কঠোর নীতি ও সুদের চাপ
কঠোর মুদ্রানীতি ও রাজস্ব নীতি গ্রহণের ফলে সুদের হার বেড়েছে, যা শিল্পখাতে ঋণগ্রহণ ব্যয় বাড়িয়েছে। ফলে নতুন উদ্যোগ ও অবকাঠামো প্রকল্প স্থবির হয়ে পড়ছে।
বৈদেশিক চাহিদা ও রপ্তানিতে ধীরগতি
বৈশ্বিক মন্দা ও বাজারে ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়ায় বাংলাদেশের রপ্তানি খাতে চাপ তৈরি হয়েছে। পোশাক শিল্পের প্রধান ক্রেতা দেশগুলোতে চাহিদা কমে যাওয়ায় রপ্তানি আয়ও হ্রাস পাচ্ছে।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও জলবায়ু ঝুঁকি
২০২৪ সালের আগস্টে বন্যা ও অতিবৃষ্টিতে কৃষি, যোগাযোগ ও অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই দুর্যোগগুলো কৃষি উৎপাদন ও সরবরাহ শৃঙ্খলে বড় ধরনের বিঘ্ন ঘটায়, যা জিডিপির ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে।
অর্থনৈতিক সঙ্কেত ও মাইক্রোশক
আইএমএফ মিশন রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২৪–২৫ অর্থবছরের প্রথমার্ধে ‘ইয়ার-অন-ইয়ার’ ভিত্তিতে প্রবৃদ্ধি ৩.৩% এ নেমে এসেছে, যা এক বছর আগের একই সময়ের ৫.১% থেকে অনেক কম। অর্থনৈতিক অস্থিরতা, ঋণগ্রহণে অনীহা এবং আর্থিক খাতে দুর্বলতা সামগ্রিক অর্থনীতিকে চাপে ফেলছে।
বাজেট ও রাজস্ব সংগ্রহের চ্যালেঞ্জ
রাজস্ব ঘাটতি পূরণে করব্যবস্থা বাড়ানো বা সামাজিক ছাড় কমানোর চাপ তৈরি হয়েছে। নতুন বাজেটে এসব পদক্ষেপ নেওয়া হলেও এর প্রভাব দৃশ্যমান হতে সময় লাগবে।
ভাবমূর্তি ও আস্থা সংকট
অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমিয়ে দিচ্ছে। পরিকল্পনা বিলম্বিত হচ্ছে, নতুন প্রকল্প অনুমোদন ঝুলে যাচ্ছে। এমন অবস্থায় ঋণের বোঝা ও প্রকল্প ব্যর্থতার মতো ঝুঁকি আরও বাড়তে পারে।
বিশ্লেষণ ও ভবিষ্যৎ করণীয়
আগস্ট ২০২৪ থেকে শুরু হওয়া অর্থনৈতিক ধীরগতি এখন দেশের অর্থনীতির জন্য এক গভীর চিন্তার কারণ। আইএমএফ ও অন্যান্য সংস্থা যেখানে ৩.৭৬% প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস দিচ্ছে, সেখানে বাজারের ভেতরে আরও ধীরগতি ও অন্তর্নিহিত ঝুঁকির আশঙ্কা রয়েছে।
এই অবস্থায় প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে হলে প্রয়োজন দ্রুত ও কার্যকর নীতি গ্রহণ, জনআস্থা পুনরুদ্ধার, বিনিয়োগ-বান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করা এবং জলবায়ু ঝুঁকি মোকাবিলায় টেকসই পদক্ষেপ নেওয়া। সঠিক দিকনির্দেশনা ও স্বচ্ছ প্রশাসনিক প্রক্রিয়া ছাড়া অর্থনীতির পুনরুদ্ধার দীর্ঘায়িত হতে পারে।
#বাংলাদেশঅর্থনীতি #জিডিপিপ্রবৃদ্ধি #IMF #WorldBank #ADB #বাংলাদেশবাজেট #অর্থনৈতিকসংকট #সারাক্ষণরিপোর্ট