আদালতে জামায়াতে ইসলামী ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিতর্ক
জামায়াতে ইসলামী’র নিযুক্ত আইনজীবী আদালতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে পুনঃস্থাপন বা সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী পুনঃবহালের শুনানীকালে বলেছেন, আগামী নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অধীনে নয়।
জামায়াতে ইসলামী’র এ মামলার একজন বাদী। তাই তার আইনজীবীর ওই বক্তব্য কখনই তাঁর নিজস্ব নয়, এটা তিনি যে দলের পক্ষের আইনজীবী তাদেরই বক্তব্য।
জামায়াতে ইসলামী’র আইনজীবীর এ বক্তব্যের মধ্যদিয়ে একটি বিষয় পরিষ্কার হলো, তারা আগামী নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে চায় না। অন্যদিকে তাদের দলের পক্ষ থেকে আবার গণভোট চাওয়া হচ্ছে।
গণভোট ও সংবিধানের বাস্তবতা
বর্তমান সরকার যে সংবিধানের অধীনে শপথ নিয়েছে, এই সংবিধানে গণভোটের কোনো বিধান নেই। সংবিধানে যে গণভোটের বিধান রাখা হয়েছিল, যদি বিচার বিভাগের মাধ্যমে তা পুনঃস্থাপন হয়, তাহলেও সে গণভোট অনুষ্ঠান করানোর ক্ষমতা চলে যাবে সংসদের হাতে। নতুন সংসদ নির্বাচন না হওয়া অবধি এবং নতুন সংসদের সদস্যদের মতামত ছাড়া গণভোটের আইনত কোনো সুযোগ নেই।

ঐকমত্য কমিশনের রিপোর্ট
জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে মতভেদ
সব মিলে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে সবার আগে প্রয়োজন জাতীয় সংসদ নির্বাচন। কিন্তু এই জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে বর্তমান সরকারের অনুকূল দৃষ্টিতে যে রাজনৈতিক দলগুলো আছে, তাদের ভেতর—জামায়াতে ইসলামী ও বিএনপিই জাতীয় সংসদে আসন পাবার মতো রাজনৈতিক দল। এই দুই দলের মধ্যেও জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে মতভেদ দেখা যাচ্ছে। বাদবাকি ছোট ছোট যে দলগুলো, তাদেরও একই অবস্থা।
বিএনপির মহাসচিব অবশ্য এই ভিন্ন মত কমানোর জন্য জামায়াতে ইসলামী ও অন্যান্য ছোট দলগুলোকে তাদের সঙ্গে একমত হবার জন্যে বলেছেন।
আদালতের বক্তব্য বনাম বিএনপির অবস্থান
কিন্তু আদালতে যেমন জামায়াতে ইসলামী নেতা বলেছেন, আগামী নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নয়, তেমনি বিএনপি নেতা আমির খসরু মাহমুদ সাংবাদিকদের বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ছাড়া কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না।
এর আগে মুহাম্মদ ইউনুসের সঙ্গে দেখা করে বিএনপি কয়েকজন উপদেষ্টা সম্পর্কে তাদের আপত্তি জানিয়ে—এই সরকারকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো কাজ করার জন্যে বলে আসে। কোনো কোনো উপদেষ্টা সম্পর্কে তাদের আপত্তি জানিয়ে সে বিষয়ে অবশ্য সাংবাদিকদের কিছু বলেনি বিএনপি। এমনকি এটাও বলেনি, তাদের বাদ দিলেও এই সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠান করানোর মতো একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার কীভাবে হবে?
বিচারাধীন বিষয় ও জনমত
অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী’র আইনজীবী তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে বলেছেন, আগামী নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নয়। কিন্তু তিনি বলেননি, কোন সরকারের অধীনে হবে। বিএনপিও এই মামলার বাদী। তারা প্রকাশ্যে বলছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না।
বিষয়টি বিচারাধীন, তাই এ নিয়ে অপেক্ষা করতে হবে বিচার বিভাগের রায় অবধি।

অটো পাস
রায়ের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃস্থাপন সম্পর্কে যে রায় আসুক, তা দেশবাসী মেনে নিতে বাধ্য। কিন্তু এই বিচার বিভাগের রায় ও জামায়াতে ইসলামী’র দাবির বাইরে গিয়ে ভিন্ন বিষয় দেশবাসীর সামনে আসছে—আর যাই হোক, মুহাম্মদ ইউনুস সরকারের অধীনে কি আদৌ কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন হবে?
ঐকমত্য, অটো পাস ও রাজনৈতিক হাস্যরস
মুহাম্মদ ইউনুস গত প্রায় চৌদ্দ মাস সময় নিয়ে নির্বাচন, সংবিধান, এমনই অনেকগুলো বিষয়ে যাদের নিয়ে কমিশন করেছেন, তাদের দেওয়া “ঐকমত্যের” সর্বশেষ সুপারিশকে বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন আহমেদ পরীক্ষায় “অটো পাসের” সঙ্গে তুলনা করেছেন।
সালাউদ্দিন আহমেদ প্রশাসন থেকে রাজনীতিতে এসেছেন। কিন্তু তার রাজনৈতিক রসবোধকে প্রশংসা করতেই হয়। আলী রিয়াজ, বদিউল আলম মজুমদারদের কাজের সারসংক্ষেপ যে এমন দুটো শব্দে সঠিক প্রকাশ করা যায়, তা সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে।
এবং এর ভেতর দিয়ে সরকারের চৌদ্দ মাসের সারসংক্ষেপ শুধু নয়, ভবিষ্যতও দেখা যাচ্ছে। কারণ সরকার প্রধানও ওই “অটো পাসের” সুপারিশ পেয়ে বলেছেন, এর ভেতর দিয়ে তার মতে, জাতি নাকি অতীত মুক্ত হলো।
জাতি, অতীত ও ভবিষ্যতের প্রশ্ন
একটা জাতি, মানবগোষ্ঠী, তার সভ্যতা, তার সকল অর্জন, তার ধর্ম–অধর্ম সবই মিলে তার দীর্ঘ অতীত। আর তার ওপর দাঁড়িয়ে তাকে বর্তমানে কাজ করতে হবে ভবিষ্যতের জন্য। সেখান থেকে মুক্ত হয়ে কীভাবে—এটা প্রশ্ন নয়, হতবাক হবার বিষয়।
সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তা
যাহোক, বিষয়টি যেহেতু অটো পাসের, তাই তা নিয়ে যে অবস্থানে থেকে যে যাই বলুক না কেন, তা জাতির জন্য প্রয়োজনীয় কোনো বিষয় নয়। এ মুহূর্তে জাতির জন্য প্রয়োজন একটা সুষ্ঠু এবং সকলের অংশগ্রহণের নির্বাচন।

অটো এমপি
গত ১৪ মাসে এই সরকারের তথাকথিত সংস্কারের স্বরূপ দেখার পরে জাতির কাছে স্বাভাবিকই পরিষ্কার, মুহাম্মদ ইউনুসের অধীনে কোনো নির্বাচন হলে সে নির্বাচনও হবে এই “ঐকমত্য’র রিপোর্টের” মতো।
অর্থাৎ অটো পাসের মতো অটো এমপি। জাতি ২০১৪ থেকে অটো এমপি দেখতে দেখতে ক্লান্ত। আর এই অটো এমপি হবার ফলে শুধু যে আওয়ামী লীগের রাজনীতি নষ্ট হয়েছে তা নয়, সব দলেরই রাজনীতি নষ্ট হয়েছে।
ধর্ম, রাজনীতি ও অটো এমপির অতীত
রাজনীতিতে যতগুলো দল থাকুক না কেন, এবং যত মত ও পথ থাকুক না কেন, রাজনীতির কোনো একটি দল যদি ভাইরাসে আক্রান্ত হয়, অন্যরা তার থেকে রেহাই পায় না। যেমন বাংলাদেশে কোনো দলকে সেক্যুলার বলা হয়, কোনো দলকে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল বলা হয়।
কিন্তু বাস্তবতা হলো, রাজনীতির সঙ্গে যেদিনই ধর্ম মেশানো হয়েছে, সেদিন থেকেই কিন্তু সব দলই পাল্লা দিচ্ছে কে কত ধর্মের পক্ষে। যেমন ভারতের পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল নেতা মমতা ব্যানার্জি বিজেপির ধর্মীয় রাজনীতি নিয়ে সারাদিন বলছেন। অথচ তিনি পুরীর জগন্নাথ মন্দির পশ্চিমবঙ্গে প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছেন। অর্থাৎ এখানে তিনিও ধর্মে আরও এক পা এগিয়ে গেছেন।
বাংলাদেশেও কিন্তু অটো এমপির অতীত খুঁজতে গেলে দৈর্ঘ্যটা অনেক বড়ই হবে। আর সত্যি অর্থে মাঝে মাঝে প্রকৃত নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার এই “অটো এমপি” ঠেকিয়ে দিয়েছে। অন্যদিকে মুহাম্মদ ইউনুস ১৪ মাসে নতুন ধরনের “অটো এমপি” তৈরির পথ খুঁজছেন, না হয় তার সরকারকে দীর্ঘায়িত করার পথ খুঁজছেন।

রাজনীতিবিদদের দায়িত্ব ও জনগণের ভূমিকা
তাই রাজনীতিবিদরা যদি তাদের রাজনীতি বাঁচাতে চান, তাহলে তাদের “অটো এমপি” তৈরি না হয়, এমন নির্বাচন অনুষ্ঠান করানোর মতোই সরকার তৈরির কথা ভাবতে হবে।
আর যেহেতু ভালো-মন্দ মিশিয়ে শেষ অবধি প্রকৃত রাজনীতিবিদরাই সাধারণ জনগণের কাছে থাকে, তাদের ভাষা ও দুঃখ-কষ্ট বোঝে—তাই প্রকৃত রাজনীতিবিদদের যদি রাজনীতি অঙ্গনে ফিরতে হয়, তাহলে সে যে পেশা থেকেই রাজনীতিতে আসুক না কেন, তাকে সুষ্ঠু নির্বাচনের ভেতর দিয়েই আসতে হবে।
সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য, অটো এমপি থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য—শুধু কোনো পদ্ধতির সরকার নয়, কোন ব্যক্তির নেতৃত্বের সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে, সেটাও বড়। এ সিদ্ধান্ত নেবার জন্যে মূল শক্তি শেষ বিচারে জনগণ।
রাজনীতিবিদরা সাধারণ জনগণের ভাষা শোনার দিকে মনোযোগ দিলেই বুঝতে পারবেন। জনগণের ভাষা না শুনলে অটো পাসে আর অটো এমপির চক্রেই বাধা পড়ে থাকবে দেশ।
লেখক: সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক, সম্পাদক, সারাক্ষণ, The Present World.

 
																			 স্বদেশ রায়
																স্বদেশ রায়								 


















