স্বদেশ রায়
একটি জাতি বা নরগোষ্টি’র অগ্রযাত্রা সব সময়ই নির্ভর করে তার সংস্কৃতির সমকালীন ও ভবিষ্যতমুখী রূপান্তরের ওপর। সংস্কৃতির সব সময়ই দুটো স্তর থাকে। একটি আচরণ, অন্যটি চর্চা। আচরণটি সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে মিশে থাকে। চর্চাটি থাকে পরিশীলিত বা প্রজ্ঞামূখী মানুষের জন্যে। যা সনজিদা খাতুনের মহান পিতা, বাঙালির অন্যতম চিন্তা নায়ক কাজী মোতাহার হোসেন সংঙায়িত করেছেন, “ সংস্কৃতি” শিক্ষিত মানুষের ধর্ম। এখানে বলে রাখা উচিত, কাজী মোতাহার হোসেন কিন্তু শিক্ষিত বলতে শুধুমাত্র চাকুরির জন্যে যারা সার্টিফিকেট অর্জন করে তাদেরকে বোঝাননি, যারা প্রজ্ঞামূখী তাদেরকে বুঝিয়েছেন।
সংস্কৃতি সব সময়ই ভূগোল থেকে উত্থিত। মানুষ ও সমাজের মনোজাগতিক, কর্ম ও পরিবেশগত রূপান্তরের সঙ্গে সঙ্গে সংস্কৃতিরও রূপান্তর হয়। বাঙালি জাতির সংস্কৃতি বা বাঙালি সংস্কৃতি হাজার হাজার বছর ধরে গড়ে উঠেছে। এবং হাজার হাজার বছর ধরে এ রূপান্তরিত হয়েছে। এই রূপান্তরের নানা অধ্যায় আছে। বহু নায়ক আছেন।
১৯৪৭ এর পরে পূর্ববাংলা পৃথক হবার ফলে ঢাকা প্রাদেশিক রাজধানী হয়। আবার এই প্রাদেশিক রাজধানী সৃষ্টি হবার সঙ্গে সঙ্গেই তার শিক্ষিত সমাজের মধ্যে ভাষাভিত্তিক একটি আন্দোলন শুরু হয়। যে কোন ভাষা ভিত্তিক আন্দোলন, একটি জাতি বা একটি জনগোষ্টিকে দ্রুত এক ধরনের জাতীয়তাবাদী করে তোলে। শুধু ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের সব থেকে ভয়াবহ দিক হলো এটাও অনেকটা বিশ্বাসভিত্তিক ধর্মীয় মৌলবাদের মতো মৌলবাদী করে তোলে। আবার ভাষাকে কখনই অস্বীকার করা যায় না। এবং ভাষা শুধু মানুষকে অন্য জীবের থেকে দ্রুত পার্থক্য করে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেনি, ভাষার সব থেকে বড় দিক, এর কোন বিশ্বাস ভিত্তিক ধর্মীয় চরিত্র নেই। ভাষা সব সময়ই ভূগোল নির্ভর। এবং ওই ভূগোলের সব মানুষের।
বাঙালির এই ভাষা ভিত্তিক জাতীয়তাবাদ যে সময়ে রাজনীতিবিদ ও ছাত্র রাজনীতির হাত ধরে দ্রুত এগিয়ে চলছিলো সে সময়ে স্বাভাবিকই একটি আধুনিক বাঙালি জাতি গড়ে তোলার বিষয়টি অন্তঃসলীলার মতো জম্ম নেয় বাঙালি জীবনে। যাকে উপলব্দি করা, যাকে দেখতে পাওয়া এবং এই অন্তঃসলীলাকে প্রবাহমান নদী তৈরি করার কাজটি তখন অনিবার্য হয়ে ওঠে।
ওই অন্ত:সলীলাকে প্রবাহমান নদীতে পরিণত করতে হলে, জাতীয়তাবাদকে তথাকথিত বিশ্বাসের মৌলবাদের বাইরে এনে একটি ইনকুলুসিভ এবং কনসেপচুয়াল জাতীয়তাবাদে পরিণত করতে হলে প্রথমেই প্রয়োজন হয় জাতীয়তাবাদকে ভূগোল ভিত্তিক সংস্কৃতির ওপর দাঁড় করানো। সে সংস্কৃতি অবশ্যই হতে হবে চর্চা-নির্ভর, সম সাময়িক মধ্যবিত্ত জীবনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। তার সঙ্গে যোগ থাকবেনা কোন অলৌকিক বিশ্বাস নির্ভরতার বরং তা হবে আধুনিকতা ও ইহজাগতিকতা নির্ভর।
পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়া বা ঢাকা পূর্ববাংলার রাজধানী হবার অনেক আগে থেকে- বাস্তবে উনবিংশ শতাব্দী’র শুরু থেকেই বাঙালি ইউরোপীয় নব জাগরণকে চিনতে শুরু করে। শুধু চিনতে হয় আত্মস্থ করা শুরু করে। যদিও তারা মাত্র কয়েকজন ছিলেন, তারপরেও তাদের ভেতর এই সাংস্কৃতিক উদারতার যাত্রা শুরু হয়। কিন্তু তারা শুরু করলেও বিষয়টিকে একটি পরিপূর্ণ চিন্তার কাঠামো দিতে পারছিলেন না। আর সেটা না পারারই কথা। কারণ, সভ্যতার যে কোন পর্যায়ের শুরু এমনই থাকে। এখানে শুধু লক্ষ্যনীয় থাকে, তাদের চিন্তা ভবিষ্যতমূখী ও ইহজাগতিক কিনা। এরপরে বহুপথ বেয়ে রবীন্দ্রনাথ এসে দাঁড়ালেন বাঙালির জীবনে আকাশের রবি’র মতো। তার চিন্তাসহ আধুনিক বাঙালি সংস্কৃতির বহু দিক নির্মানসহ এমন একটি জগত তিনি করেন যা শুধু সমসাময়িক শিক্ষিত ও আধুনিক মানুষের সংস্কৃতি বা ধর্ম নয়-তা ভবিষ্যতমূখীও। এটাকে আরো প্রসারিত করে রবীন্দ্র পরবর্তী নজরুল যুগের তরুণ তুর্কীরা।
বাঙালির এই আধুনিক সংস্কৃতি, রবীন্দ্র- নজরুল আশ্রয়কেন্দ্রিক মনোজাগতিক গঠন তৈরি’র জন্যে সে সময়ে যে ক’জন সব থেকে বড় ভূমিকা রাখেন তারা ছিলেন, ক্ষীতিমোহন সেন, সৈয়দ মুজতবা আলী, আবু সাঈয়িদ আইয়ুব, কাজী আব্দুল ওদুদ, কাজী মোতাহার হোসেন, আবুল হোসেন প্রমূখ।
রবীন্দ্রনাথ, নজরুল থেকে শুরু করে কাজী মোতাহার হোসেন অবধি সকলেই মূলত চেতনার জগতে, চিন্তার জগতে সর্বোপরি চর্চার জগতে পরিবর্তন আনেন বেশি। রবীন্দ্রনাথ তার সৃষ্ট বিদ্যায়তন শান্তি নিকেতনে খুবই স্বল্প পরিসরে এর প্রায়োগিক দিক তৈরির কাজটি শুরু করেছিলেন। তিনি বাঙালির জন্য উত্সবগুলো প্রকৃতির পরিবর্তনের সঙ্গে জুড়ে দেবার চেষ্টা করেন। এ অবশ্য নতুন কিছু নয়, ভূমিজাত সংস্কৃতিতে সকল উত্সবই প্রকৃতির পরিবর্তনের সঙ্গে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। রবীন্দ্রনাথ তারই আধুনিক প্রায়োগিক রূপ সৃষ্টি করার চেষ্টা করেন স্বল্প পরিসরে। কিন্তু বৃহত্তর জনগোষ্টি বা তার রাষ্ট্র ও সমাজের বড় অংশ তার সঙ্গে সংযুক্ত হয় না। বরং রবীন্দ্র পরবর্তী ওই ভূমি তথাকথিত বামপন্থার প্রবল রাজনৈতিক স্রোত দিয়ে ভূমিজাত সংস্কৃতিকে মাটি চাপা দিয়ে ফেলার এক বিকৃত চেষ্টা শুরু করে।
অন্যদিকে সনজিদা খাতুনের নেতৃত্বে পূর্ববাংলায় ষাটের দশকে শুরু হয় বাঙালি সংস্কৃতির এই রূপান্তরিত আধুনিক রূপ এর প্রায়োগিক দিক তৈরি করা। যার ভিত্তিমূল ছিলো রবীন্দ্র পূর্ববর্তী সময় থেকে যাত্রা শুরু করা ও রবীন্দ্র নজরুল বেয়ে সম্পূর্ণ পরিপূষ্ট যে ভান্ডারে পরিনত হয়েছিলো সেটাই। যার ফলে মানুষ তার চর্চায় ও আধুনিক জীবনে সেই সংস্কৃতিকে আশ্রয় করে বেঁচে থাকতে, আনন্দিত হতে এবং ভবিষ্যতের আধুনিকতার সঙ্গে নিজেকে গেঁথে নেবার জীবনাচারণ তৈরি করতে পারে। বলা যেতে পারে উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দী’র শুরুতে বাঙালি মণীষাদের চিন্তার মধ্য দিয়ে বাঙালি সংস্কৃতির যে আধুনিক রূপ তৈরি হয়েছিলো- তার সত্যি অর্থে প্রায়োগিক কাজটি শুরু হয় সনজিদা খাতুনের নেতৃত্বে।
সময়টা ছিলো পূর্ববাংলায় ষাটের দশকে। যে সময়টা এখানে রাজনীতিও ধর্মাশ্রয়ীতা থেকে বের হয়ে এসে ইহজাগতিকতা খুঁজছে। পূর্ববাংলার নতুন শিক্ষিত তরুণরাও খুঁজছে আপন সংস্কৃতি নির্ভর একটি ইহজাগতিক জীবনাচরণ। সনজিদা খাতুন শুরুতে সংস্কৃতির আধুনিক রূপান্তরের যে প্রায়োগিক দিকটির আলোর শিখাটি জ্বালেন, যা খুবই ছোট আকারে ছিলো- কিন্তু তা দ্রুত একটি স্পার্কে রূপ নেয়। কারণ, সমাজ ও মনোজগত তার জন্যে প্রস্তুত হয়েছিলো। সনজিদা খাতুনের নেতৃত্বে তাই যে সংস্কৃতির প্রদীপটি প্রজ্জলন হয় সেটি ক্ষীন মাটির প্রদীপ শিখা হলেও দ্রুতই চাঁদের আলো হয়ে ওঠে। এমনকি হয়ে ওঠে সূর্য রেখাও এ পূর্ববাংলার জাতীয় জীবনে। যা শুধু বাঙালি সংস্কৃতির আধুনিক রূপান্তর ঘটায় না, বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকে ভাষা ভিত্তিক একক অবস্থান থেকে টেনে এনে সংস্কৃতির বহুমাত্রিক কোলে তুলে দেয়। যার ফলে বাঙালির নতুন দেশ তৈরির রাজনীতির যাত্রাটি হয় ইনকুলুসিভ। সকল আধুনিকতাকে ধারণ করে।
বাস্তবে যে শিখাটি সনজিদা খাতুনের নেতৃত্বে জ্বালা হয়েছিলো তা কীভাবে দ্রুত সমাজে ও রাজনীতিতে আধুনিকতা ও ইহ-জাগতিকতার স্নিগ্ধ আলোতে পরিণত হয় তা ভবিষ্যতের গবেষকরা বহু গবেষণার ভেতর দিয়ে বিস্তারিত তুলে আনতে পারবেন। আর সনজিদা খাতুনের সৃষ্ট এই নতুন প্রায়োগিক স্নিগ্ধ সাংস্কৃতিক আলো মূলত ষাটের দশক থেকে নব্বই এর দশক অবধি এ ভূখন্ডের রাজনীতি ও সমাজকে অনেক বেশি পরিশোধিত করতে ও রাখতে সাহায্য করে। কারণ, সমাজ ও রাজনীতি দুটোরই বেশি অংশ তখন নিয়ন্ত্রিত করতো বাঙালি সংস্কৃতির রূপান্তরিত এই আধুনিক রূপ।
নব্বইয়ের দশকের থেকে ধীরে ধীরে এদেশের রাজনীতি মানুষের সংস্কৃতি ও জীবন বোধ পরিবর্তনের পরিবর্তে ক্ষমতা কেন্দ্রিক হয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে হয়ে পড়ে ধর্মাশ্রয়ী। এবং ভোটের স্বার্থে সমাজের নিম্মবর্গীয় চিন্তার আচরণকে রাজনীতিতে ধারণ করতে শুরু করে। রাজনীতির এই নিম্মগতি মূলত রাজনীতিকে বোধ ও চর্চাহীন মানুষের আচরণ নির্ভর করে তোলে। এ ধরনের রাজনীতি এবং রাজনীতি আশ্রয়ী রাষ্ট্র আসলে সর্বগ্রাসী রাক্ষসের মতো হয়। আর রাজনীতি ও রাষ্ট্র যখন সমাজের সবটুকু গ্রাস করে ফেলে- স্বাভাবিকভাবে তখন সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে বোধ ও চর্চা দূরে সরে যায়। চর্চা, ও সাংস্কৃতিক বোধের বদলে চর্চাহীন মানুষের তথাকথিত বিশ্বাস ও আচরণ সংখ্যাগরিষ্টতার জোরে চালকের আসনে বসে যায়। কোন রাষ্ট্র ও সমাজ যখন এদিকে ধাবিত হয় তখন ওই সমাজের জন্য যে স্নিগ্ধ আলো ছিলো- তা ক্ষীন প্রদীপ হয়ে কিছু মানুষের মনের ভেতর বা গৃহের ভেতর আশ্রয় নেয়। সমাজ ও রাষ্ট্র তখন জবরদস্তি শক্তির কবলিত থাকে নানান রূপে ।
তাই সনজিদা খাতুন, যিনি আধুনিক বাঙালি সংস্কৃতির প্রায়োগিক নেতা ও অন্যতম স্রষ্টা। যিনি বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতিসত্ত্বার সঙ্গে আধুনিক বাঙালির সংস্কৃতির যোগ ঘটানোর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। যিনি সত্যি অর্থে আধুনিক বাঙালি জীনবযাপনের শিক্ষক ও আপনজন ছিলেন। তিনি চলে গেলেন অনেকটা নীরবে। কারণ, তিনি যখন চলে গেলেন এ সময়টা রাষ্ট্র ও সমাজ তাঁকে ধারণ করার মত অত বড় পাত্র নয়। তবু আশা ছলনা নয়, সত্য হলো- কোন একদিন বাঙালিমাত্রই খুঁজবে- বাস্তবে সনজিদা খাতুন বাঙালির কে ছিলেন?
লেখকঃ রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক, সম্পাদক সারাক্ষণ, The Present World.