প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নয়াদিল্লি থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ঘোষণা করেন। যদিও প্রকল্পটির নাম ‘মুখ্যমন্ত্রী মহিলা রোজগার যোজনা’, তবে ঘোষণাটি করেন প্রধানমন্ত্রী নিজেই, মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার নন। নির্বাচনের মুখে থাকা বিহারে ৭৫ লাখ নারী প্রত্যেকে ১০ হাজার রুপি করে সহায়তা পাবেন জীবিকা কার্যক্রম শুরু করতে।
বিজেপি বর্তমানে নীতীশ কুমারের জনতা দল (ইউনাইটেড)-এর জোটসঙ্গী। “এটা স্পষ্ট যে বিজেপি উন্নয়ন মডেলের ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ রাখতে চায় এবং প্রধানমন্ত্রী বিহারের উন্নয়ন মডেলে নিজের ছাপ রাখতে আগ্রহী, যা ২০০৬–০৭ সাল থেকে নীতীশ কুমারের নেতৃত্বে গড়ে উঠেছে,” বলেন মনীষা প্রিয়ম, মোনাশ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার লুই ম্যাথেসন ডিস্টিংগুইশড ভিজিটিং প্রফেসর।
এটি এমন এক মডেল, যা এতদিনে নীতীশ কুমারকে বিপুল সাফল্য এনে দিয়েছে। গত ২০ বছর ধরে তিনি মূলত নারী ভোটারদের সমর্থন ও নারীদের লক্ষ্য করে চালু করা কর্মসূচির ওপর নির্ভর করে ক্ষমতায় আছেন। এসব কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে—
- • স্কুলছাত্রীদের বিনামূল্যে সাইকেল দেওয়া, যাতে স্কুল ছাড়ার হার কমে।
- • পঞ্চায়েত ও নগর প্রশাসনে ৫০ শতাংশ নারী সংরক্ষণ।
- • সরকারি চাকরিতে ৩৫ শতাংশ সংরক্ষণ।
- • ‘জীবিকা’ নামে স্বনির্ভর গোষ্ঠীভিত্তিক জীবিকা উন্নয়ন প্রকল্প, যেখানে সদস্য সংখ্যা ১ কোটি ২০ লাখের বেশি নারী।
২০১৫ সালের নির্বাচনে তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, জয়ী হলে রাজ্যে মদ নিষিদ্ধ করবেন। রেকর্ড ৬০.৫ শতাংশ নারী ভোটার ভোট দেন এবং তাঁকে জয়ী করেন। অর্থনৈতিক ক্ষতির আশঙ্কা থাকা সত্ত্বেও মুখ্যমন্ত্রী তাঁর প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেন।
বিহার এমন একটি রাজ্য, যেখানে পুরুষ অভিবাসীর সংখ্যা তুলনামূলকভাবে বেশি। ফলে ২০১০ সাল থেকে নারী ভোটারের উপস্থিতি পুরুষদের চেয়ে ধারাবাহিকভাবে বেশি।
- • ২০১০ সালে নারী ভোট ৫৪.৫%, পুরুষ ভোট ৫১.১%
- • ২০১৫ সালে নারী ভোট ৬০.৫%, পুরুষ ভোট ৫৩.৩%
- • ২০২০ সালে নারী ভোট ৫৯.৭%, পুরুষ ভোট ৫৪.৭%
২০২০ সালের নির্বাচনে নীতীশ কুমার নেতৃত্বাধীন এনডিএ অল্প ব্যবধানে জয় পায়। লোকনীতি–সিএসডিএস-এর বিশ্লেষণে দেখা যায়, তরুণী ভোটাররা এই জয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। ১৮ থেকে ২৯ বছর বয়সী নারীদের ৪০ শতাংশ এনডিএ-কে ভোট দেন, যেখানে একই বয়সী পুরুষদের মধ্যে এই হার ছিল মাত্র ৩৩ শতাংশ।
একসময় প্রধানমন্ত্রী মোদি যেসব নগদ সহায়তা প্রকল্পকে ‘রেভড়ি’ বা ‘ফ্রি উপহার’ বলে সমালোচনা করেছিলেন, সেই প্রকল্পই এখন বিভিন্ন রাজ্যের নির্বাচনী কৌশলের কেন্দ্রে। মধ্যপ্রদেশ থেকে শুরু করে মহারাষ্ট্র, কর্ণাটক ও হিমাচল পর্যন্ত ১১টি রাজ্যে প্রায় ১১.৩ কোটি নারী মাসে ১,০০০ থেকে ২,৫০০ রুপি পর্যন্ত পাচ্ছেন। আরও পাঁচটি রাজ্য একই ধরনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে।
কিংস কলেজ লন্ডনের অধ্যাপক প্রভা কোটিস্বরণ ২০২৫ সালের জুলাইয়ে প্রকাশিত এক নীতিপত্রে উল্লেখ করেছেন, “এই নগদ সহায়তা নারীদের গৃহস্থালি অবৈতনিক শ্রমের স্বীকৃতি।” তাঁর গবেষণায় দেখা গেছে, এই অর্থের ফলে নারীরা ওষুধ, স্বাস্থ্য এবং পারিবারিক কল্যাণে বেশি খরচ করছেন। প্রায় ৯৯ শতাংশ নারী নিজেদের প্রাপ্ত টাকার ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখছেন, যা তাঁদের গৃহস্থালি সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা বাড়িয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক পরিষদের সদস্য শামিকা রবি বলেন, “যেসব পরিবারে ঐতিহ্যগতভাবে বৈষম্য বিদ্যমান, সেখানে নারীদের হাতে নগদ অর্থ পৌঁছানো তাঁদের আর্থিক ও সামাজিক ক্ষমতায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।”
কিন্তু এই নগদ সহায়তা সরকারকে বড় আর্থিক চাপে ফেলছে। এর ব্যয় হিমাচলে ২০০ কোটি রুপি থেকে মহারাষ্ট্রে গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৩৬,০০০ কোটি রুপিতে। প্রশ্ন উঠছে—রাজ্য সরকারগুলো কি এই ব্যয় দীর্ঘমেয়াদে বহন করতে পারবে? এর ফলে কি স্বাস্থ্য ও শিক্ষাখাতে বরাদ্দ কমবে? এবং নারী কর্মসংস্থানের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো—যেমন শিশু যত্নকেন্দ্র—এই বিনিয়োগে প্রভাব ফেলবে কি না?
এই মুহূর্তে বিহারে মূল প্রশ্ন একটাই—নির্বাচনী জয় কতটা নিশ্চিত করা যায়। অন্তত একটি বিষয় স্পষ্ট, নগদ সহায়তার প্রতিশ্রুতি নারী ভোটারের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের সাক্ষ্য দিচ্ছে, যা আর অস্বীকার করা সম্ভব নয়।
নমিতা ভান্ডারে – নারী ক্ষমতায়ন বিষয়ক লেখক