০২:০০ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ০১ অগাস্ট ২০২৫

পাকিস্তান‑বাংলাদেশের যৌথ জঙ্গী বিরোধী উদ্যোগ: ঝুঁকি নাকি সুযোগ?

বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের পক্ষ থেকে সম্প্রতি বলা হয়েছে দুই দেশ জঙ্গি দমনে একসঙ্গে কাজ করবে।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা দুই দিন আগে নিউ ইয়র্কে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইউসুফ দারার সঙ্গে যে বৈঠকে মিলিত হন সেখানেও দুই দেশ নানান বিষয়ে একসঙ্গে কাজ করবে বলে একমত হয়েছে।
বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের জঙ্গি দমনে একসঙ্গে কাজ করার ঘোষণা ও পরে দুই দিন আগে নিউ ইয়র্কে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টার বৈঠকের মাঝখানে পাকিস্তানের অন্যতম জঙ্গি সংগঠন লস্কর‑ই‑তৈয়বার একটি ভিন্ন নামধারী সংগঠন টিআরএফ (দ্য রেজিস্ট্যান্ট ফ্রন্ট) আমেরিকার পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।
ট্রাম্প প্রশাসনকে অনেকে মনে করেন, এ ধরনের টেররিজমের বিষয়ে তারা বেশি সেনসেটিভ, কিন্তু ২০২৩‑এর আমেরিকান স্টেট ডিপার্টমেন্টের রিপোর্ট— যা সকলে জানেন, সেখানে বলা হয়েছে পাকিস্তানে ভয়াবহ ৮৭টি জঙ্গি সংগঠন আছে। তার ভেতর ৪১টি জঙ্গি সংগঠন পুরোপুরি সক্রিয়। তারা ভয়াবহ জঙ্গি আক্রমণ করে। তাছাড়া ওই রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, সেখানকার মাদ্রাসাগুলো সশস্ত্র জঙ্গি আক্রমণের উদ্দেশ্যে শিক্ষা দিয়ে থাকে।
এছাড়া সম্প্রতি পাকিস্তানে ভারতের অপারেশন সিঁদুর চলাকালে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মি. দারা এক টিভি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, দীর্ঘদিন যাবৎ পাকিস্তানকে এই জঙ্গি বাস্তবতা মেনে নিতে হচ্ছে। জঙ্গি বাস্তবতা যে পাকিস্তান মেনে নিয়েছে তার প্রমাণ আমেরিকায় ওবামা প্রশাসনের সময়েও প্রমাণিত হয়েছিল। লাদেনকে হত্যা করার জন্যে আমেরিকান ওবামা প্রশাসন যে অপারেশন চালিয়েছিল সেটা পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদে। এবং পাকিস্তানকে কোনো রূপ না জানিয়েই আমেরিকা ওই সামরিক অভিযান চালায়।


পরবর্তীতে আমেরিকার পত্রপত্রিকা ও অনেকগুলো কাউন্টার টেররিজম জার্নালে বলা হয়, আমেরিকা সঠিক পথে ওই অপারেশন চালিয়েছিল। কারণ, পাকিস্তান সরকার বা সামরিক বাহিনীকে জানালে তাদের ওই অপারেশন ব্যর্থ হতো। তারা লাদেনকে হয় অন্য স্থানে সরিয়ে নিত না হয় তাকে ভিন্ন স্থানে যেতে সহায়তা করতো।
ওই সকল বিশ্লেষকদের বক্তব্য যে সত্য তার যথেষ্ট প্রমাণ আছে সুইডেন হামলায় ধরা পড়া এক জঙ্গীর বক্তব্য থেকে জানা গিয়েছিল তারা শুধু জঙ্গিদের কাছ থেকে ট্রেনিং নেয়নি, পাকিস্তান সেনাবাহিনীও তাদেরকে ট্রেনিং দিয়েছে— ঠিক এই বক্তব্যের মিল পাওয়া যায় ওই বইয়ে চায়নার উইঘুর টেররিস্টদের ট্রেনিং নিয়ে। সেখানে বক্তব্যটা ঠিক এমনভাবে আছে— পাকিস্তানের একটি প্রত্যন্ত এলাকা থেকে কয়েকজন চাইনিজ উইঘুর তরুণ একটি প্রাইভেট যানবাহনে অনেকটা জনবিরল স্থানে নামে। তাদের পেশি, তাদের চেহারায় দীর্ঘ একটা প্রশিক্ষণের ছাপ। তারা আবার ফিরে যাবে উইঘুরে। আর ওই তরুণদের যাত্রাপথ নিশ্চিত করছে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্যরা।
ঠিক একই দৃশ্য এবার ভারতের পহেলগাম হামলার সময়ে ও পরে দেখা গেছে। ভারত যখন পাকিস্তানে লস্কর‑ই‑তৈয়বার হেডকোয়ার্টারে সার্জিকাল স্ট্রাইক করে ওই সময়ে ও পরে লস্কর‑ই‑তৈয়বার হেডকোয়ার্টারের নিরাপত্তায় পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে দেখা গেছে। আর এই লস্কর‑ই‑তৈয়বার একটি অপারেশনাল ফ্রন্ট টিআরএফকে সম্প্রতি আমেরিকা আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়। যদিও এটা কিছুটা ইউটোপিয়— তারপরেও ধরে নেওয়া যেতে পারে সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব। আর সে হিসেবে পাকিস্তানের সঙ্গে একটা সম্পর্ক বাংলাদেশের থাকবেই। তবে কোন কোন ক্ষেত্রে এবং কতটুকু সম্পর্ক রাখলে বাংলাদেশের লাভ— তা নিঃসন্দেহে ভেবে দেখার প্রয়োজন আছে।


বাংলাদেশ ও পাকিস্তান যে মুহূর্তে একযোগে জঙ্গী দমনের কাজে যাবে সেই মুহূর্ত থেকে বাংলাদেশকে পাকিস্তানের সেনা গোয়েন্দা বাহিনী ও সিভিল গোয়েন্দা বাহিনীর সঙ্গে কাজ করতে হবে। পাকিস্তানের এই দুটো অংশের একটি বড় অংশ তাদের দেশের টেররিস্ট অর্গানাইজেশনের সঙ্গে জড়িত। পাকিস্তান চর্চা যারা করেন, তারা সকলেই জানেন, পাকিস্তান রাষ্ট্রটিতে রাষ্ট্রের মধ্যে অনেকগুলো রাষ্ট্র বা অনেকগুলো পাওয়ার সেন্টার। এবং কিছু কিছু পাওয়ার সেন্টার আছে যারা সরকারকেও অগ্রাহ্য করে। তাছাড়া তাদের অর্থের বিশাল উৎস রয়েছে। আমেরিকার স্টেট ডিপার্টমেন্টের রিপোর্টে বলা হচ্ছে, অজানা ডোনেশন এবং চাঁদাবাজি এই জঙ্গি সংগঠনগুলোর অর্থের উৎস।
প্রেসিডেন্ট বুশ বলেছিলেন, “মানি ইজ দ্য ব্লাড অব টেররিজম”। বাস্তবে যারা অতি সামান্য টেররিজম নিয়ে পড়াশোনা করেন, তারা সকলেই জানেন, টেররিজম যতটা না আইডিওলজির (কারণ অসৎ কোনো আদর্শ হয় না, ওটা একটা লক্ষ্যমাত্র) ওপর দাঁড়িয়ে থাকে, তার চেয়ে বেশি দাঁড়িয়ে থাকে অর্থের ওপর। আর পাকিস্তানের ওই অজানা ডোনেশন অর্থই হলো দেশি ও বিদেশি আন্তর্জাতিক টেররিস্ট ফান্ডিং। তাছাড়া মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট উল্লেখ করেছে, অন্য উৎসটি চাঁদাবাজি।
বাংলাদেশ সরকার এমন একটা সময়ে পাকিস্তানের মতো দেশের সঙ্গে জঙ্গি নিয়ে কাজ করা শুরু করেছে, যে সময়ে বাংলাদেশে দক্ষিণপন্থী বা মৌলবাদীদের উত্থান ঘটেছে। বাংলাদেশে বর্তমানে যে অন্তর্বর্তী ব্যবস্থার সরকার, সে সরকার প্রধান বলেছেন, তিনি একটি মেটিকিউলাস ডিজাইনের মাধ্যমে পিপল আপরাইজিং ঘটিয়ে ক্ষমতা নিয়েছেন।
তার কথা সত্য। প্রকৃত পিপল আপরাইজিং হলে, সেই আপরাইজিং‑এর তরুণ নেতারা এত দ্রুত জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তো না। শুধু তাই নয় এক বছর না যেতেই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত শুধু নয়, তাদের কেন্দ্রীয় তরুণ নেত্রী ও নেতারা বলছেন, তারা ভুল করেছিলেন। তারা আন্দোলনটাকে প্রগ্রেসিভ কিছু মনে করেছিলেন। অন্যদিকে দেশের প্রবীণতম বুদ্ধিজীবী বদরুদ্দিন ওমর, যিনি বিগত সরকারেরও কঠোর সমালোচক ছিলেন, তিনি সম্প্রতি বলেছেন, বাংলাদেশে ২০২৪‑এর আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে ডানপন্থার উত্থান ঘটেছে। অন্যদিকে দেশের সেন্টার রাইট বড় দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)‑এর মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, দেশে বিগত সরকারের পতনের পরে দক্ষিণপন্থার উত্থানে তিনি উদ্বিগ্ন।


বাংলাদেশের সরকার পরিবর্তনের মাধ্যমে যে তরুণদের উত্থান ঘটেছে, তাদের পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ড খুব দরিদ্র ছিল। কেউই মধ্যবিত্ত নয়। কিন্তু যারা রাজনৈতিক দল করেছে বা সরকারে আছে— তাদের অর্থবিত্তের বহিঃপ্রকাশ অনেকটা অস্বাভাবিক। পাশাপাশি তাদের কর্মীরা বড় বড় চাঁদাবাজিতে লিপ্ত বলে নানা সংবাদমাধ্যমে সংবাদ আসছে। এমনকি পুলিশ প্রশাসনও তাদের কয়েকজনকে চাঁদাবাজির কারণে গ্রেফতার করেছে।
তাই এই দক্ষিণপন্থী তরুণদের অজানা উৎস থেকে অর্থ আসা ও চাঁদাবাজি দুটোই অনেকখানি মিলে যায় আমেরিকান স্টেট ডিপার্টমেন্টের রিপোর্টে পাকিস্তানি জঙ্গিদের অর্থের উৎসের চরিত্রের সঙ্গে।
দেশের এমন একটি ডানপন্থার উত্থানের সময়ে, তার ওপরে যেখানে বর্তমান সরকারের মানসিক অংশ যে বুদ্ধিজীবীগণ তারাও মিডিয়ায় বলছেন, সরকারের ভেতর অনেকগুলো সরকার আছে। কোনো দেশে যখন এমন হয়, অর্থাৎ সরকারের মধ্যে অনেকগুলো সরকার থাকে, তখন স্বাভাবিকই ধরে নেওয়া হয় ওই সরকার স্থিতিশীল ও শক্তিশালী সরকার নয়, বরং অনেক দুর্বল সরকার।
তাই দেশে যখন এ ধরনের দুর্বল সরকারের (সরকার প্রতিপক্ষকে কত শক্তভাবে দমন করছে— এটা কখনও সরকারের সবলতার প্রমাণ করে না। এবং যে সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে এই সরকার এসেছে, ওই আগের সরকারের পতন থেকেও কিন্তু তাদের বোঝা উচিত প্রতিপক্ষকে দমন করার শক্তি আর সরকার পরিচালনা ও টিকে থাকার শক্তি এক নয়।) কী উচিত হবে একটি জঙ্গি‑কবলিত দেশ, যে দেশটির সকল অঙ্গে জঙ্গিরা মিশে আছে— তাদের সঙ্গে এ মুহূর্তে জঙ্গি দমন নিয়ে কাজ করতে যাওয়া। এর পজিটিভ দিকের চেয়ে ব্যাকল্যাশটা কি আগে ভাবা উচিত নয়?


কারণ, যাদের সঙ্গে কাজ করবেন, তারা নিঃসন্দেহে অবাধে এ দেশে আসবে। যারা আসবে তাদের কোনো অংশ জঙ্গি আর কোনো অংশ জঙ্গি নয়— সেটা কীভাবে নির্ধারণ হবে? যে অংশ জঙ্গি, তারা যে এখানে জঙ্গির শাখাকে আরও শক্তিশালী করবে না তার নিশ্চয়তা কী? আর যেহেতু দক্ষিণপন্থার উত্থান ঘটেই গেছে তাই তাদের জন্যে তো একটা উর্বর ব্রিডিং গ্রাউন্ড তৈরি হয়ে আছে। যখন এ ধরনের ব্রিডিং গ্রাউন্ড তৈরি হয় তখন তাতে যেন আরও বেশি সার ও বীজ না পড়ে, সে চিন্তাই জঙ্গি দমনের জন্যে করতে হয়। আর তার জন্যে প্রয়োজন পৃথিবীতে প্রকৃত অর্থে কোন কোন দেশ জঙ্গি নির্মূলে কাজ করছে তাদের সঙ্গে কাজ করা।
এর বিপরীতে জঙ্গিবাদের জন্যে আন্তর্জাতিকভাবে চিহ্নিত একটি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের বর্তমানের দক্ষিণপন্থা ও উগ্রবাদের উত্থানের সময় এ ধরনের যোগসূত্র তৈরি করার ফলে— আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি আরও খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। শুধু তাই নয়, এ দেশের দক্ষিণপন্থাদের বা উগ্রবাদীদের মানসিক শক্তি ও যোগাযোগ বৃদ্ধির সুযোগ করে দেওয়া হবে না কি?
এ ছাড়া এ মুহূর্তে বাংলাদেশের নাগরিক, বিশেষ করে তরুণদের ভিসা, পড়াশোনার সুযোগ অনেক জঙ্গিমুক্ত দেশে বা জঙ্গি‑বিরোধী দেশে কমে আসছে। পাকিস্তানের সঙ্গে বেশি যোগাযোগ হলে এই সব তরুণ যদি পাকিস্তানে ভ্রমণেও যায় তাহলেও ভবিষ্যতে তাদের উন্নত, জঙ্গিমুক্ত দেশের ভিসা পেতে বা পড়াশোনার সুযোগ পেতে কিছুটা হলেও অসুবিধা হবে— এটা তো সকলেই জানে।
তাই সকলের সঙ্গে বন্ধুত্বের পররাষ্ট্রনীতি হলেও, পাকিস্তানের মতো একটি জঙ্গি‑কবলিত দেশের সঙ্গে কতটুকু এগোতে হবে এবং কোথায় গিয়ে থামতে হবে— সেটা নির্ধারণ না করলে মূলত দেশটিকে ভিন্ন খাদে কি ঠেলে দেওয়া হবে না?

লেখক: সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক, সম্পাদক, সারাক্ষণ, The Present World.

বিদ্যুৎচালিত গাড়িতে নেপালের বিশুদ্ধ বাতাসের স্বপ্ন

পাকিস্তান‑বাংলাদেশের যৌথ জঙ্গী বিরোধী উদ্যোগ: ঝুঁকি নাকি সুযোগ?

০৮:০০:৪৫ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৩১ জুলাই ২০২৫

বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের পক্ষ থেকে সম্প্রতি বলা হয়েছে দুই দেশ জঙ্গি দমনে একসঙ্গে কাজ করবে।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা দুই দিন আগে নিউ ইয়র্কে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইউসুফ দারার সঙ্গে যে বৈঠকে মিলিত হন সেখানেও দুই দেশ নানান বিষয়ে একসঙ্গে কাজ করবে বলে একমত হয়েছে।
বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের জঙ্গি দমনে একসঙ্গে কাজ করার ঘোষণা ও পরে দুই দিন আগে নিউ ইয়র্কে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টার বৈঠকের মাঝখানে পাকিস্তানের অন্যতম জঙ্গি সংগঠন লস্কর‑ই‑তৈয়বার একটি ভিন্ন নামধারী সংগঠন টিআরএফ (দ্য রেজিস্ট্যান্ট ফ্রন্ট) আমেরিকার পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।
ট্রাম্প প্রশাসনকে অনেকে মনে করেন, এ ধরনের টেররিজমের বিষয়ে তারা বেশি সেনসেটিভ, কিন্তু ২০২৩‑এর আমেরিকান স্টেট ডিপার্টমেন্টের রিপোর্ট— যা সকলে জানেন, সেখানে বলা হয়েছে পাকিস্তানে ভয়াবহ ৮৭টি জঙ্গি সংগঠন আছে। তার ভেতর ৪১টি জঙ্গি সংগঠন পুরোপুরি সক্রিয়। তারা ভয়াবহ জঙ্গি আক্রমণ করে। তাছাড়া ওই রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, সেখানকার মাদ্রাসাগুলো সশস্ত্র জঙ্গি আক্রমণের উদ্দেশ্যে শিক্ষা দিয়ে থাকে।
এছাড়া সম্প্রতি পাকিস্তানে ভারতের অপারেশন সিঁদুর চলাকালে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মি. দারা এক টিভি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, দীর্ঘদিন যাবৎ পাকিস্তানকে এই জঙ্গি বাস্তবতা মেনে নিতে হচ্ছে। জঙ্গি বাস্তবতা যে পাকিস্তান মেনে নিয়েছে তার প্রমাণ আমেরিকায় ওবামা প্রশাসনের সময়েও প্রমাণিত হয়েছিল। লাদেনকে হত্যা করার জন্যে আমেরিকান ওবামা প্রশাসন যে অপারেশন চালিয়েছিল সেটা পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদে। এবং পাকিস্তানকে কোনো রূপ না জানিয়েই আমেরিকা ওই সামরিক অভিযান চালায়।


পরবর্তীতে আমেরিকার পত্রপত্রিকা ও অনেকগুলো কাউন্টার টেররিজম জার্নালে বলা হয়, আমেরিকা সঠিক পথে ওই অপারেশন চালিয়েছিল। কারণ, পাকিস্তান সরকার বা সামরিক বাহিনীকে জানালে তাদের ওই অপারেশন ব্যর্থ হতো। তারা লাদেনকে হয় অন্য স্থানে সরিয়ে নিত না হয় তাকে ভিন্ন স্থানে যেতে সহায়তা করতো।
ওই সকল বিশ্লেষকদের বক্তব্য যে সত্য তার যথেষ্ট প্রমাণ আছে সুইডেন হামলায় ধরা পড়া এক জঙ্গীর বক্তব্য থেকে জানা গিয়েছিল তারা শুধু জঙ্গিদের কাছ থেকে ট্রেনিং নেয়নি, পাকিস্তান সেনাবাহিনীও তাদেরকে ট্রেনিং দিয়েছে— ঠিক এই বক্তব্যের মিল পাওয়া যায় ওই বইয়ে চায়নার উইঘুর টেররিস্টদের ট্রেনিং নিয়ে। সেখানে বক্তব্যটা ঠিক এমনভাবে আছে— পাকিস্তানের একটি প্রত্যন্ত এলাকা থেকে কয়েকজন চাইনিজ উইঘুর তরুণ একটি প্রাইভেট যানবাহনে অনেকটা জনবিরল স্থানে নামে। তাদের পেশি, তাদের চেহারায় দীর্ঘ একটা প্রশিক্ষণের ছাপ। তারা আবার ফিরে যাবে উইঘুরে। আর ওই তরুণদের যাত্রাপথ নিশ্চিত করছে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্যরা।
ঠিক একই দৃশ্য এবার ভারতের পহেলগাম হামলার সময়ে ও পরে দেখা গেছে। ভারত যখন পাকিস্তানে লস্কর‑ই‑তৈয়বার হেডকোয়ার্টারে সার্জিকাল স্ট্রাইক করে ওই সময়ে ও পরে লস্কর‑ই‑তৈয়বার হেডকোয়ার্টারের নিরাপত্তায় পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে দেখা গেছে। আর এই লস্কর‑ই‑তৈয়বার একটি অপারেশনাল ফ্রন্ট টিআরএফকে সম্প্রতি আমেরিকা আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়। যদিও এটা কিছুটা ইউটোপিয়— তারপরেও ধরে নেওয়া যেতে পারে সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব। আর সে হিসেবে পাকিস্তানের সঙ্গে একটা সম্পর্ক বাংলাদেশের থাকবেই। তবে কোন কোন ক্ষেত্রে এবং কতটুকু সম্পর্ক রাখলে বাংলাদেশের লাভ— তা নিঃসন্দেহে ভেবে দেখার প্রয়োজন আছে।


বাংলাদেশ ও পাকিস্তান যে মুহূর্তে একযোগে জঙ্গী দমনের কাজে যাবে সেই মুহূর্ত থেকে বাংলাদেশকে পাকিস্তানের সেনা গোয়েন্দা বাহিনী ও সিভিল গোয়েন্দা বাহিনীর সঙ্গে কাজ করতে হবে। পাকিস্তানের এই দুটো অংশের একটি বড় অংশ তাদের দেশের টেররিস্ট অর্গানাইজেশনের সঙ্গে জড়িত। পাকিস্তান চর্চা যারা করেন, তারা সকলেই জানেন, পাকিস্তান রাষ্ট্রটিতে রাষ্ট্রের মধ্যে অনেকগুলো রাষ্ট্র বা অনেকগুলো পাওয়ার সেন্টার। এবং কিছু কিছু পাওয়ার সেন্টার আছে যারা সরকারকেও অগ্রাহ্য করে। তাছাড়া তাদের অর্থের বিশাল উৎস রয়েছে। আমেরিকার স্টেট ডিপার্টমেন্টের রিপোর্টে বলা হচ্ছে, অজানা ডোনেশন এবং চাঁদাবাজি এই জঙ্গি সংগঠনগুলোর অর্থের উৎস।
প্রেসিডেন্ট বুশ বলেছিলেন, “মানি ইজ দ্য ব্লাড অব টেররিজম”। বাস্তবে যারা অতি সামান্য টেররিজম নিয়ে পড়াশোনা করেন, তারা সকলেই জানেন, টেররিজম যতটা না আইডিওলজির (কারণ অসৎ কোনো আদর্শ হয় না, ওটা একটা লক্ষ্যমাত্র) ওপর দাঁড়িয়ে থাকে, তার চেয়ে বেশি দাঁড়িয়ে থাকে অর্থের ওপর। আর পাকিস্তানের ওই অজানা ডোনেশন অর্থই হলো দেশি ও বিদেশি আন্তর্জাতিক টেররিস্ট ফান্ডিং। তাছাড়া মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট উল্লেখ করেছে, অন্য উৎসটি চাঁদাবাজি।
বাংলাদেশ সরকার এমন একটা সময়ে পাকিস্তানের মতো দেশের সঙ্গে জঙ্গি নিয়ে কাজ করা শুরু করেছে, যে সময়ে বাংলাদেশে দক্ষিণপন্থী বা মৌলবাদীদের উত্থান ঘটেছে। বাংলাদেশে বর্তমানে যে অন্তর্বর্তী ব্যবস্থার সরকার, সে সরকার প্রধান বলেছেন, তিনি একটি মেটিকিউলাস ডিজাইনের মাধ্যমে পিপল আপরাইজিং ঘটিয়ে ক্ষমতা নিয়েছেন।
তার কথা সত্য। প্রকৃত পিপল আপরাইজিং হলে, সেই আপরাইজিং‑এর তরুণ নেতারা এত দ্রুত জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তো না। শুধু তাই নয় এক বছর না যেতেই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত শুধু নয়, তাদের কেন্দ্রীয় তরুণ নেত্রী ও নেতারা বলছেন, তারা ভুল করেছিলেন। তারা আন্দোলনটাকে প্রগ্রেসিভ কিছু মনে করেছিলেন। অন্যদিকে দেশের প্রবীণতম বুদ্ধিজীবী বদরুদ্দিন ওমর, যিনি বিগত সরকারেরও কঠোর সমালোচক ছিলেন, তিনি সম্প্রতি বলেছেন, বাংলাদেশে ২০২৪‑এর আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে ডানপন্থার উত্থান ঘটেছে। অন্যদিকে দেশের সেন্টার রাইট বড় দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)‑এর মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, দেশে বিগত সরকারের পতনের পরে দক্ষিণপন্থার উত্থানে তিনি উদ্বিগ্ন।


বাংলাদেশের সরকার পরিবর্তনের মাধ্যমে যে তরুণদের উত্থান ঘটেছে, তাদের পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ড খুব দরিদ্র ছিল। কেউই মধ্যবিত্ত নয়। কিন্তু যারা রাজনৈতিক দল করেছে বা সরকারে আছে— তাদের অর্থবিত্তের বহিঃপ্রকাশ অনেকটা অস্বাভাবিক। পাশাপাশি তাদের কর্মীরা বড় বড় চাঁদাবাজিতে লিপ্ত বলে নানা সংবাদমাধ্যমে সংবাদ আসছে। এমনকি পুলিশ প্রশাসনও তাদের কয়েকজনকে চাঁদাবাজির কারণে গ্রেফতার করেছে।
তাই এই দক্ষিণপন্থী তরুণদের অজানা উৎস থেকে অর্থ আসা ও চাঁদাবাজি দুটোই অনেকখানি মিলে যায় আমেরিকান স্টেট ডিপার্টমেন্টের রিপোর্টে পাকিস্তানি জঙ্গিদের অর্থের উৎসের চরিত্রের সঙ্গে।
দেশের এমন একটি ডানপন্থার উত্থানের সময়ে, তার ওপরে যেখানে বর্তমান সরকারের মানসিক অংশ যে বুদ্ধিজীবীগণ তারাও মিডিয়ায় বলছেন, সরকারের ভেতর অনেকগুলো সরকার আছে। কোনো দেশে যখন এমন হয়, অর্থাৎ সরকারের মধ্যে অনেকগুলো সরকার থাকে, তখন স্বাভাবিকই ধরে নেওয়া হয় ওই সরকার স্থিতিশীল ও শক্তিশালী সরকার নয়, বরং অনেক দুর্বল সরকার।
তাই দেশে যখন এ ধরনের দুর্বল সরকারের (সরকার প্রতিপক্ষকে কত শক্তভাবে দমন করছে— এটা কখনও সরকারের সবলতার প্রমাণ করে না। এবং যে সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে এই সরকার এসেছে, ওই আগের সরকারের পতন থেকেও কিন্তু তাদের বোঝা উচিত প্রতিপক্ষকে দমন করার শক্তি আর সরকার পরিচালনা ও টিকে থাকার শক্তি এক নয়।) কী উচিত হবে একটি জঙ্গি‑কবলিত দেশ, যে দেশটির সকল অঙ্গে জঙ্গিরা মিশে আছে— তাদের সঙ্গে এ মুহূর্তে জঙ্গি দমন নিয়ে কাজ করতে যাওয়া। এর পজিটিভ দিকের চেয়ে ব্যাকল্যাশটা কি আগে ভাবা উচিত নয়?


কারণ, যাদের সঙ্গে কাজ করবেন, তারা নিঃসন্দেহে অবাধে এ দেশে আসবে। যারা আসবে তাদের কোনো অংশ জঙ্গি আর কোনো অংশ জঙ্গি নয়— সেটা কীভাবে নির্ধারণ হবে? যে অংশ জঙ্গি, তারা যে এখানে জঙ্গির শাখাকে আরও শক্তিশালী করবে না তার নিশ্চয়তা কী? আর যেহেতু দক্ষিণপন্থার উত্থান ঘটেই গেছে তাই তাদের জন্যে তো একটা উর্বর ব্রিডিং গ্রাউন্ড তৈরি হয়ে আছে। যখন এ ধরনের ব্রিডিং গ্রাউন্ড তৈরি হয় তখন তাতে যেন আরও বেশি সার ও বীজ না পড়ে, সে চিন্তাই জঙ্গি দমনের জন্যে করতে হয়। আর তার জন্যে প্রয়োজন পৃথিবীতে প্রকৃত অর্থে কোন কোন দেশ জঙ্গি নির্মূলে কাজ করছে তাদের সঙ্গে কাজ করা।
এর বিপরীতে জঙ্গিবাদের জন্যে আন্তর্জাতিকভাবে চিহ্নিত একটি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের বর্তমানের দক্ষিণপন্থা ও উগ্রবাদের উত্থানের সময় এ ধরনের যোগসূত্র তৈরি করার ফলে— আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি আরও খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। শুধু তাই নয়, এ দেশের দক্ষিণপন্থাদের বা উগ্রবাদীদের মানসিক শক্তি ও যোগাযোগ বৃদ্ধির সুযোগ করে দেওয়া হবে না কি?
এ ছাড়া এ মুহূর্তে বাংলাদেশের নাগরিক, বিশেষ করে তরুণদের ভিসা, পড়াশোনার সুযোগ অনেক জঙ্গিমুক্ত দেশে বা জঙ্গি‑বিরোধী দেশে কমে আসছে। পাকিস্তানের সঙ্গে বেশি যোগাযোগ হলে এই সব তরুণ যদি পাকিস্তানে ভ্রমণেও যায় তাহলেও ভবিষ্যতে তাদের উন্নত, জঙ্গিমুক্ত দেশের ভিসা পেতে বা পড়াশোনার সুযোগ পেতে কিছুটা হলেও অসুবিধা হবে— এটা তো সকলেই জানে।
তাই সকলের সঙ্গে বন্ধুত্বের পররাষ্ট্রনীতি হলেও, পাকিস্তানের মতো একটি জঙ্গি‑কবলিত দেশের সঙ্গে কতটুকু এগোতে হবে এবং কোথায় গিয়ে থামতে হবে— সেটা নির্ধারণ না করলে মূলত দেশটিকে ভিন্ন খাদে কি ঠেলে দেওয়া হবে না?

লেখক: সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক, সম্পাদক, সারাক্ষণ, The Present World.