০৮:৩২ অপরাহ্ন, শনিবার, ০২ অগাস্ট ২০২৫
ট্রাম্পের ট্যারিফে আফ্রিকা চীনের কোলে মাশরাফি বিন মর্তুজা: বাংলাদেশের এক মহান ক্রিকেটারের জীবনগাথা ট্রাম্পের শুল্ক ভারতের ৪০ বিলিয়ন ডলারের রফতানির ওপর প্রভাব ফেলতে পারে ফেডারেল তহবিল কাটা যাওয়ায় পাবলিক ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন বন্ধ, স্থানীয় গণমাধ্যমে বড় ধাক্কা ট্রেড আলোচনা স্থবির, শুল্ক হুমকি বাড়ছে: যুক্তরাষ্ট্র–ভারত অংশীদারিত্বে টানাপোড়ন  বাংলাদেশে দুই কোটি হিন্দুর ও প্রগতিশীল মুসলিমদের ভবিষ্যত কি? জলঢাকা নদী: ইতিহাস, পথচলা ও বর্তমান বাস্তবতা বাংলাদেশে কার্প মাছ চাষ: দেশি মাছের বৈচিত্র্য ধ্বংসের হুমকি ও করণীয় বম জনগোষ্ঠীর তিন সদস্যের কারা মৃত্যু—বিচারবিভাগীয় তদন্ত ও নিরপরাধ বন্দিদের মুক্তির দাবিতে ১৫৫ নাগরিকের বিবৃতি উন্নত দেশগুলোর জন্য কৃষিপণ্যের বাজার উন্মুক্ত করা কি সুবিবেচনার কাজ?

বাংলাদেশে দুই কোটি হিন্দুর ও প্রগতিশীল মুসলিমদের ভবিষ্যত কি?

যশোরের অভয়নগরের একটি সাজানো গোছানো সুন্দর এলাকা নিয়েযেখানে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষেরা বেশ আনন্দেই বাস করতো বলে বোঝা গেলো তাদের পুড়ে যাওয়া বাড়িঘরগুলো দেখে। তাদের ইট ও টিনের বাড়িইটের দেয়াল ও ইটের ছাদ ওয়ালা বাড়ি এসব দেখে ধরে নেওয়া যায় তারা বেশ নিশ্চিন্তেই এখানে বাস করতো।

রংপুরের গঙ্গা চড়ায় যাদের ওপর হামলা হলোযারা সাইকেল ভ্যানে করে তাদের মালামাল নিয়ে এলাকা ত্যাগ করলোতাদের বাড়ির মালামাল ও পেছনে ফেলে রাখা ভাঙা টিনের ঘরগুলো দেখে বোঝা যায় তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা যশোরের অভয়নগরের হিন্দুদের মতো অতটা ভালো নয়। আর এটাই স্বাভাবিক কারণরংপুরের সাধারণ মানুষের অর্থনীতি ভালো হতে শুরু করেছে আসলে ২০০৮-এর পর থেকে। সেখান থেকে সত্যি অর্থে মঙ্গা উঠে গেছে গত দশ থেকে বারো বছর মাত্র।

অভয়নগরে দেখা গেলো যেভাবে নারীদের ওপর হামলা হয়েছে। বাড়িঘর ভাঙা হয়েছেঠিক একইভাবে বাড়িঘর ভাঙা হয়েছে রংপুরের গঙ্গাচড়ায়হামলা হয়েছে নারীদের ওপর

অন্যদিকে৫ আগস্টের পরে যখন ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন মবের মাধ্যমে বিভিন্ন স্কুলকলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পদত্যাগ করানো হচ্ছিলোসে সময়ের কুমিল্লার একটি স্কুলের এক ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষিকার পদত্যাগ করানোর একটি ভিডিও সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় এসেছে। ভদ্র মহিলা হিন্দুমধ্যবয়স্ক শিক্ষিকা। তাকে পদত্যাগে বাধ্য করার জন্যে একটি রুমে নিয়ে গিয়ে শুধু নির্যাতনই করা হয়নি। এক পর্যায়ে তার শরীর অনাবৃত করা হয়। তার পরে অনেকখানি অনাবৃত সেই স্কুল শিক্ষিকাকে ওইভাবে রাস্তায় ঘোরানো হয়।

যশোরের অভয়নগর থেকেকুমিল্লা ও রংপুরের গঙ্গাচড়ায় সব জায়গাতেই হামলার শিকারে নারীরা বাদ যায়নি। অন্যদিকে কুমিল্লাঅভয়নগর ও গঙ্গাচড়ার ঘটনা ছাড়াও গত বছর ৫ আগস্টের পরে এক সপ্তাহের মধ্যে প্রায় আড়াই হাজারের মতো এ ধরনের ঘটনার বিবরণ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্যপরিষদ দিয়েছিল। যে তথ্য প্রথম আলো কিছুটা হলেও ভেতরের পাতায় ছেপেছিল।

বাংলাদেশে ১৯৭১-এর পরে বর্তমান সময়ের মতো এত বড় আকারে না হলেও প্রথম বড় আকারে হিন্দুদের ওপর নির্যাতন শুরু হয় ২০০১ সালে লতিফুর রহমানের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। ওই সময়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে শুরু হওয়া ওই নির্যাতনের রেশ সরকার পরিবর্তনের পরে আরও মাসখানেক ধরে চলতে থাকে।

তবে ওই সময়ের সঙ্গে বর্তমান সময়ের পার্থক্য হলো তখন মেইনস্ট্রিম মিডিয়া ঘটনাগুলো প্রকাশ পেত। যেমন তখন অধ্যক্ষ মুহুরী হত্যার পরে তাঁর ছবি ও সংবাদ সব মিডিয়া প্রকাশ করেছিল। অথচ বর্তমানে ময়মনসিংহে একজন প্রাক্তন অধ্যক্ষকে হত্যা করা হয়েছে অনেকটা প্রকাশ্যেখবরটা শুধুমাত্র সোশ্যাল মিডিয়ায় পেয়েছি।

তাছাড়া ২০০১-এর ওই হিন্দু নির্যাতনের সময় ড. আনিসুজ্জামানওয়াহিদুল হক প্রমুখের নেতৃত্বে প্রতিবাদ হয়েছিল। ড. আনিসুজ্জামানের নেতৃত্বে একটি কমিটি তৈরি হয়ে বুদ্ধিজীবিরা গোটা দেশ ঘুরেন।

বর্তমানে মিডিয়া কেন প্রকাশ করে না তা আমি মিডিয়ার মানুষ হয়েও পুরোপুরি বুঝি না। তবে ওই সময়ে প্রধান মিডিয়া ছিল সংবাদপত্র। তার অধিকাংশের মাথার ওপর অসাম্প্রদায়িক ও শিক্ষিতজন ছিলেন। তাদের কয়েকজন এখনও আছেনতবে কেন তারা প্রকাশ করেন নাতার কারণ ঠিক জানি না। কারণ কি কোনো বাধানাতাদের মনোজাগতিক মেটামরফোসিস হয়েছেনাতারাও আতঙ্কে তা বুঝতে পারি না। অন্যদিকে বুদ্ধিজীবিদের এই নিশ্চুপতার কারণ নিয়ে একজন বুদ্ধিজীবি ও মানবাধিকার নেত্রী বললেন, “তুমি ২০০১-এর যে বুদ্ধিজীবিদের কথা বলছোতারা এখন বেঁচে থাকলে সকলেই হত্যা মামলার আসামী হতেন। তারা হিন্দু নির্যাতন নিয়ে কথা বলতে পারতেন না।

তাহলে বাংলাদেশের এই হিন্দুদের ভবিষ্যত কিযেখানে রাষ্ট্র তার পাশে নেইসমাজের একটি প্রগতিশীল অংশের মানসিক মেটামরফোসিসের ফলে তারা নির্যাতনের পক্ষে সফট অবস্থান নিয়েছেন। আরেকটি অংশকে রাষ্ট্র ভীত করে রেখেছে। এ অবস্থায় শতভাগ অসহায় এই দুই কোটি মানুষের ভবিষ্যত কি?

আমি সাংবাদিকঅর্ধশিক্ষিতকোন বিষয়ে পণ্ডিত নইআবার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মত পদাধিকারবলে বুদ্ধিজীবিও নই। তাই বুদ্ধিবৃত্তির গভীরে গিয়ে এদের ভবিষ্যত খোঁজার সক্ষমতা ও জ্ঞান আমার নেই। তবে এখন মনে হয়আমার মতো মানুষের ওই ভবিষ্যত খুঁজে কোন লাভ নেই। কারণ সাধারণ মানুষ যে বাস্তবতা বোঝেআমাদের মতো যারা দেশ ও জাতি নিয়ে স্বপ্ন দেখিহয়তো বাস্তবতার মাটিতে তাদের থেকে আমরা পিছিয়ে আছি।

কারণ২০০১-এর পর থেকে সাধারণ হিন্দুরা কিন্তু নীরবে মাইগ্রেশনকে বেছে নিয়েছে। আসামের শিলচরত্রিপুরার আগরতলা ও তার আশেপাশেপশ্চিমবঙ্গের ২৪ পরগনার যাদবপুরমধ্যমগ্রামবাসন্তীসন্দেশখালি আবার মালদহবীরভূমজলপাইগুড়িশিলিগুড়ি এসব জায়গায় গিয়ে দেখেছি ২০০১-এর পর থেকে আসা হাজার হাজার হিন্দু পরিবার। ঠিক এই হারে অবশ্য বিহারদিল্লিমধ্যপ্রদেশে না থাকলেও ওড়িশায় গিয়ে প্রচুর পরিবার পেয়েছি। যখন তাদের দেখেছিএকবার নয় বারবার দেখেছিসেই সময়ে মনে হয়েছিল এই মানুষগুলো মাতৃভূমি ছেড়ে ভুল করেছে। তখন মনে হয়েছিলএই মানুষগুলো স্বপ্ন দেখতে পারে নাটিকে থাকার লড়াই করতে পারে না বলেই পলাতকের জীবন বেছে নিয়েছে। এই কষ্ট বেছে নিয়েছে।

১৯৭১ দেখেছি২০০১ দেখেছিতারপরেও মনে হয়নি যে আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্যমাতৃভূমির থেকে নিজস্ব জীবনের নিরাপত্তা অনেক বড়। এখন যখন দেখি যারা রাষ্ট্র চালায় বিভিন্ন সময়েতাদের সন্তানরা অধিকাংশই বিদেশী নাগরিক। তারাও অধিকাংশ বিদেশী নাগরিক। অথচ তারা সংখ্যাগুরু ধর্মালম্বী। তখন বুঝতে পারিএই মানুষেরা আসলে রাষ্ট্রক্ষমতাকে কী কাজে লাগায় তা আমরা জানি না। এমনকি তারা যে তাদের নিজস্ব নিরাপত্তা আগেই নিশ্চিত করে এসব কাজে আসেতাও আমাদের মতো মানুষরা বুঝি না। বরং এদের মতো এত সুবিধা ও রাজকীয় পথে না হলেও চুপিসারে যে হিন্দুরা ২০০১-এর পর থেকে মাইগ্রেশন করেছেকেউ কেউ বলে ১৯৯২ থেকে একটা ঢেউ গেছে। এরা মনে হয় আমাদের মতো মানুষদের থেকে অনেক বেশি বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে।

যেমন এই যে এ কথা লিখছিতারপরেও কিন্তু নিজের বিশ্বাসটি ভিন্ন স্থানেসে বিশ্বাস মৃত্যু হোক আর যাই হোক তাহলে মাতৃভূমি ছাড়বো কেনএটা আমার দেশ। রাষ্ট্রের কিছু স্বার্থপর ও লোভী মানুষ আমাকে সংখ্যালঘু করেছে। কিন্তু আমার বন্ধু-বান্ধবযাদের ঘিরে আমি বেড়ে উঠেছিযাদের অনেকে আমার বড় ভাই ও পিতৃব্যর মতোতাদের ভিতর তো কখনও সংখ্যালঘু ও সংখ্যাগুরু এটা দেখেনি। নিজের মনেও তো এটা হয় না। আবার কখনও কখনও মনে হয়সাধারণ মানুষের জীবন তো আমি বুঝি নাতাদের নিরাপত্তাহীনতা বুঝি না।

যেমন মাত্র সপ্তাহ দুয়েক আগে আমার একজন আপনজন আমাকে ফোন করে বললেনঈশ্বর আমাকে রক্ষা করেছেন। এখন আর আমার মারা গেলেও কোন অসুবিধা নেই। কারণকাল মেয়েটিকে ইন্ডিয়ায় পাঠিয়ে দিতে পেরেছি। সেখানে তার একটা বিয়েরও ঠিক হয়েছে। ৫ আগস্টের পর থেকে ওই ছিল আমার সবচেয়ে বড় দুঃশ্চিন্তার কারণ।

তার ফোন রেখে অনেকক্ষণ পড়ার রুমে এসে নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকি। আসলে কে বেশি বাস্তব! ওই যে বৈধব্য জীবনে মানুষটি একাই সিদ্ধান্ত নিয়ে তার মেয়েকে ৫ আগস্টের পর ইন্ডিয়ায় পাঠিয়ে দিতে পেরেছেন তিনি নাকি আমি। তখন মনে হলোআসলে ছোটবেলা থেকে রামমোহনরবীন্দ্রনাথ আর ক্ষীতিমোহন সেনের পরে আমাকে বেশি আচ্ছন্ন করেছেলালন ও তার উত্তরসূরীরাআর সব থেকে বেশি আচ্ছন্ন করেছে কাজী আব্দুল ওদুদ ও সৈয়দ মুজতবা আলী। কাজী আব্দুল ওদুদ ও সৈয়দ মুজতবা আলী ব্রিটিশ চলে যাওয়ার পরে আর কোন মাতৃভূমি পাননি। নিরাপত্তাও পাননি। অন্যদিকে লালনও কোন ঈশ্বর নির্ভর ধর্মের কাছে আশ্রয় পানি।

তাহলে আসলে এই দুই কোটি মানুষের জন্যেই কী প্রয়োজন আগেতাদের মাতৃভূমি না তাদের নিরাপত্তাযে নারী শিক্ষিকাকে বস্ত্রহীনা করে রাস্তায় ঘোরানো হয়েছেসে তো কারো মা। আর সেই মা জন্মভূমি ও স্বর্গের থেকেও বড়। আর মা যেখানে বস্ত্রহীনা হয়সেখানে মায়ের নিরাপত্তা বড় নাকি জন্মভূমি বড়?

রাষ্ট্রচিন্তাজন্মভূমির চিন্তা যাদেরকে আবেগে আচ্ছন্ন করে রাখেতারা কি বাস্তবে মানুষের নিরাপত্তার চিন্তা করতে ভুল করেযেমন ১৯৭১ সালে নদীয়ার ডিসি ছিলেন যে ভদ্রলোকযিনি মেহেরপুরে মুজিবনগর সরকারের শপথ অনুষ্ঠান শুধু নয়তাজউদ্দিন আহমদ ও তার সঙ্গী ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলামকে বিএসএফ-এর মাধ্যমে ভারতে নেওয়ার ব্যবস্থাসহ সব কিছুরই দায়িত্ব পালন করেছিলেনওই ভদ্রলোকের সঙ্গে ২০১৭ সালে দীর্ঘক্ষণ আলাপ হয়। তিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেই চাকরি হারিয়েছিলেন। তিনি চাকরি হারিয়েছিলেন মূলত ভারতের সিভিল সার্ভিস রুল ভাঙার কারণে।

কারণভারতের সিভিল সার্ভিস রুল অনুযায়ী কোন সরকারি কর্মকর্তা কোন রাজনৈতিক মতামত দিতে পারেন না। কিন্তু তিনি সেদিন শুধু রাজনৈতিক মতামত দেননিএকজন ডিসি হয়েও তিনি সরাসরি ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে চিঠি লিখেছিলেন। তার চিঠির সারমর্ম ছিলশরনার্থী হিসেবে যারা ভারতে আসছেতাদের নিরানব্বই ভাগই হিন্দু। ভারত অবশ্য তাদেরকে হিন্দু না বলে পাকিস্তানের নাগরিক বলছে বিশ্ববাসীর কাছে। কিন্তু বাস্তবতা হলোপূর্বপাকিস্তানে যা ঘটছে তাতে সবচেয়ে বেশি নিরাপত্তাহীনতায় হিন্দুরা। আর তাদের বেশিভাগ নির্যাতিত হয়ে আসছে পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু মুসলিমদের দ্বারাপাকিস্তানের সেনাদের দ্বারা নয়। তাই বাংলাদেশ হলেও এই হিন্দুরা নিরাপত্তা পাবে না। বাংলাদেশ দ্রুতই পূর্ব পাকিস্তানের রূপ নেবে। তাই ভারতের উচিত হবে বাংলাদেশ স্বাধীন করে দেবার জন্য পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে নিজস্ব সম্পদ নষ্ট না করা। বরং পশ্চিম পাকিস্তান যা যাচ্ছে সে পথে হাঁটাঅর্থাৎ ভারতের সীমান্তবর্তী যে কয়েকটি জেলা পশ্চিম পাকিস্তান ছেড়ে দিতে চায়সেটা নিয়ে সেখানে হিন্দুদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা। এই ছিল মূলত তার চিঠির সারমর্ম।

এই চিঠি ইন্দিরা গান্ধীর কাছে পৌঁছানো মাত্রই তিনি তাকে চাকরিচ্যুতি করার নির্দেশ দেন। সে দেশের বিধি মতো তাকে দ্রুতই চাকরিচ্যুত করা হয়।

সেদিন তার সঙ্গে অনেক রাত অবধি আলোচনা করে হোটেলে ফিরেগভীর রাতে জানালা দিয়ে তাকিয়ে ১৯৭১ সালের শরণার্থী যে শিবিরগুলোয় আমার নিত্য পা ফেলা ছিলসেগুলোই দেখছিলাম। কারণ এই হোটেল ম্যারিয়ট এখন যেখানেএর চারপাশে তখন জলে কাঁদায় তাবুতেপাইপের মধ্যে বাস করতো শরনার্থীরা। আর তার ভেতর খালি পায়ে ছিল আমাদের নিত্য চলাচল।

তখন স্মৃতিতে জেগে ওঠে এর কাছাকাছিই ইন্দিরা গান্ধী এসেছিলেন। আর ইন্দিরা গান্ধীর সেই মুখসেই শাদা শাড়ীপাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বিজয় উল্লাস মনে পড়তেই মনের মধ্যে ক্ষণিকের জন্য হলেও একটা দ্বন্দ্ব ওঠেনি। কি বড়নিরাপত্তা না মাতৃভূমিপরে মনে হয়েছিলইন্দিরা গান্ধী যতটা ভবিষ্যত দেখতে পানঅতটা ভবিষ্যত তো একজন ডিসির পক্ষে দেখা সম্ভব নয়।

কিন্তু আজ যখন দুই কোটি হিন্দু মূলত দেশজুড়ে অভয়নগরগঙ্গাচড়া আর কুমিল্লার বস্ত্রহীনা মা ও মুরাদনগরের বস্ত্রহীনা কন্যা মত বাস করছেসেই সময়ে মাঝে মাঝে প্রশ্ন জাগে: আসলে ইন্দিরা গান্ধী থেকে শুরু করে আমাদের মতো ক্ষুদ্র মানুষআমরা যারা রাষ্ট্র ও মাতৃভূমি নিয়ে আচ্ছন্ন থাকিআমরা কি আসলে প্রকৃত অর্থে সমাজের ভালনারেবল গোষ্ঠী বা সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার বিষয়টি ভুলে যাই?

আবার হিসাব মেলাতে পারি নাসংখ্যাগুরুর মধ্যে যারা প্রকৃত অর্থে সব মানুষের একটি দেশএকটি নিজস্ব সংস্কৃতির দেশ নিয়ে কাজ করেনতারা তো বারবারই নিরাপত্তাহীনতায় পড়েন। বরং যাদের চিন্তার ভিতর এসব নিয়ে মোনাফিকি আছেঅন্ধ ধর্মব্যবসা  তাদের মনের ভিতর থাকলেও সেগুলো পোষাকে ঢাকারাই শুধু সব সময় ভালো থাকে। তাই এই প্রগতিশীল ধর্মীয় সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের মানুষ যারাতারা-ও এক ধরনের সংখ্যালঘুআবার এই দুই কোটি হিন্দু যারা ধর্মীয় কারণে সংখ্যালঘুএদের নিরাপত্তার পথ আসলে কোন পথে?

লেখক: সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিকসম্পাদক সারাক্ষণ, The Present World.

জনপ্রিয় সংবাদ

ট্রাম্পের ট্যারিফে আফ্রিকা চীনের কোলে

বাংলাদেশে দুই কোটি হিন্দুর ও প্রগতিশীল মুসলিমদের ভবিষ্যত কি?

০৫:০০:৫৭ অপরাহ্ন, শনিবার, ২ অগাস্ট ২০২৫

যশোরের অভয়নগরের একটি সাজানো গোছানো সুন্দর এলাকা নিয়েযেখানে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষেরা বেশ আনন্দেই বাস করতো বলে বোঝা গেলো তাদের পুড়ে যাওয়া বাড়িঘরগুলো দেখে। তাদের ইট ও টিনের বাড়িইটের দেয়াল ও ইটের ছাদ ওয়ালা বাড়ি এসব দেখে ধরে নেওয়া যায় তারা বেশ নিশ্চিন্তেই এখানে বাস করতো।

রংপুরের গঙ্গা চড়ায় যাদের ওপর হামলা হলোযারা সাইকেল ভ্যানে করে তাদের মালামাল নিয়ে এলাকা ত্যাগ করলোতাদের বাড়ির মালামাল ও পেছনে ফেলে রাখা ভাঙা টিনের ঘরগুলো দেখে বোঝা যায় তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা যশোরের অভয়নগরের হিন্দুদের মতো অতটা ভালো নয়। আর এটাই স্বাভাবিক কারণরংপুরের সাধারণ মানুষের অর্থনীতি ভালো হতে শুরু করেছে আসলে ২০০৮-এর পর থেকে। সেখান থেকে সত্যি অর্থে মঙ্গা উঠে গেছে গত দশ থেকে বারো বছর মাত্র।

অভয়নগরে দেখা গেলো যেভাবে নারীদের ওপর হামলা হয়েছে। বাড়িঘর ভাঙা হয়েছেঠিক একইভাবে বাড়িঘর ভাঙা হয়েছে রংপুরের গঙ্গাচড়ায়হামলা হয়েছে নারীদের ওপর

অন্যদিকে৫ আগস্টের পরে যখন ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন মবের মাধ্যমে বিভিন্ন স্কুলকলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পদত্যাগ করানো হচ্ছিলোসে সময়ের কুমিল্লার একটি স্কুলের এক ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষিকার পদত্যাগ করানোর একটি ভিডিও সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় এসেছে। ভদ্র মহিলা হিন্দুমধ্যবয়স্ক শিক্ষিকা। তাকে পদত্যাগে বাধ্য করার জন্যে একটি রুমে নিয়ে গিয়ে শুধু নির্যাতনই করা হয়নি। এক পর্যায়ে তার শরীর অনাবৃত করা হয়। তার পরে অনেকখানি অনাবৃত সেই স্কুল শিক্ষিকাকে ওইভাবে রাস্তায় ঘোরানো হয়।

যশোরের অভয়নগর থেকেকুমিল্লা ও রংপুরের গঙ্গাচড়ায় সব জায়গাতেই হামলার শিকারে নারীরা বাদ যায়নি। অন্যদিকে কুমিল্লাঅভয়নগর ও গঙ্গাচড়ার ঘটনা ছাড়াও গত বছর ৫ আগস্টের পরে এক সপ্তাহের মধ্যে প্রায় আড়াই হাজারের মতো এ ধরনের ঘটনার বিবরণ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্যপরিষদ দিয়েছিল। যে তথ্য প্রথম আলো কিছুটা হলেও ভেতরের পাতায় ছেপেছিল।

বাংলাদেশে ১৯৭১-এর পরে বর্তমান সময়ের মতো এত বড় আকারে না হলেও প্রথম বড় আকারে হিন্দুদের ওপর নির্যাতন শুরু হয় ২০০১ সালে লতিফুর রহমানের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। ওই সময়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে শুরু হওয়া ওই নির্যাতনের রেশ সরকার পরিবর্তনের পরে আরও মাসখানেক ধরে চলতে থাকে।

তবে ওই সময়ের সঙ্গে বর্তমান সময়ের পার্থক্য হলো তখন মেইনস্ট্রিম মিডিয়া ঘটনাগুলো প্রকাশ পেত। যেমন তখন অধ্যক্ষ মুহুরী হত্যার পরে তাঁর ছবি ও সংবাদ সব মিডিয়া প্রকাশ করেছিল। অথচ বর্তমানে ময়মনসিংহে একজন প্রাক্তন অধ্যক্ষকে হত্যা করা হয়েছে অনেকটা প্রকাশ্যেখবরটা শুধুমাত্র সোশ্যাল মিডিয়ায় পেয়েছি।

তাছাড়া ২০০১-এর ওই হিন্দু নির্যাতনের সময় ড. আনিসুজ্জামানওয়াহিদুল হক প্রমুখের নেতৃত্বে প্রতিবাদ হয়েছিল। ড. আনিসুজ্জামানের নেতৃত্বে একটি কমিটি তৈরি হয়ে বুদ্ধিজীবিরা গোটা দেশ ঘুরেন।

বর্তমানে মিডিয়া কেন প্রকাশ করে না তা আমি মিডিয়ার মানুষ হয়েও পুরোপুরি বুঝি না। তবে ওই সময়ে প্রধান মিডিয়া ছিল সংবাদপত্র। তার অধিকাংশের মাথার ওপর অসাম্প্রদায়িক ও শিক্ষিতজন ছিলেন। তাদের কয়েকজন এখনও আছেনতবে কেন তারা প্রকাশ করেন নাতার কারণ ঠিক জানি না। কারণ কি কোনো বাধানাতাদের মনোজাগতিক মেটামরফোসিস হয়েছেনাতারাও আতঙ্কে তা বুঝতে পারি না। অন্যদিকে বুদ্ধিজীবিদের এই নিশ্চুপতার কারণ নিয়ে একজন বুদ্ধিজীবি ও মানবাধিকার নেত্রী বললেন, “তুমি ২০০১-এর যে বুদ্ধিজীবিদের কথা বলছোতারা এখন বেঁচে থাকলে সকলেই হত্যা মামলার আসামী হতেন। তারা হিন্দু নির্যাতন নিয়ে কথা বলতে পারতেন না।

তাহলে বাংলাদেশের এই হিন্দুদের ভবিষ্যত কিযেখানে রাষ্ট্র তার পাশে নেইসমাজের একটি প্রগতিশীল অংশের মানসিক মেটামরফোসিসের ফলে তারা নির্যাতনের পক্ষে সফট অবস্থান নিয়েছেন। আরেকটি অংশকে রাষ্ট্র ভীত করে রেখেছে। এ অবস্থায় শতভাগ অসহায় এই দুই কোটি মানুষের ভবিষ্যত কি?

আমি সাংবাদিকঅর্ধশিক্ষিতকোন বিষয়ে পণ্ডিত নইআবার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মত পদাধিকারবলে বুদ্ধিজীবিও নই। তাই বুদ্ধিবৃত্তির গভীরে গিয়ে এদের ভবিষ্যত খোঁজার সক্ষমতা ও জ্ঞান আমার নেই। তবে এখন মনে হয়আমার মতো মানুষের ওই ভবিষ্যত খুঁজে কোন লাভ নেই। কারণ সাধারণ মানুষ যে বাস্তবতা বোঝেআমাদের মতো যারা দেশ ও জাতি নিয়ে স্বপ্ন দেখিহয়তো বাস্তবতার মাটিতে তাদের থেকে আমরা পিছিয়ে আছি।

কারণ২০০১-এর পর থেকে সাধারণ হিন্দুরা কিন্তু নীরবে মাইগ্রেশনকে বেছে নিয়েছে। আসামের শিলচরত্রিপুরার আগরতলা ও তার আশেপাশেপশ্চিমবঙ্গের ২৪ পরগনার যাদবপুরমধ্যমগ্রামবাসন্তীসন্দেশখালি আবার মালদহবীরভূমজলপাইগুড়িশিলিগুড়ি এসব জায়গায় গিয়ে দেখেছি ২০০১-এর পর থেকে আসা হাজার হাজার হিন্দু পরিবার। ঠিক এই হারে অবশ্য বিহারদিল্লিমধ্যপ্রদেশে না থাকলেও ওড়িশায় গিয়ে প্রচুর পরিবার পেয়েছি। যখন তাদের দেখেছিএকবার নয় বারবার দেখেছিসেই সময়ে মনে হয়েছিল এই মানুষগুলো মাতৃভূমি ছেড়ে ভুল করেছে। তখন মনে হয়েছিলএই মানুষগুলো স্বপ্ন দেখতে পারে নাটিকে থাকার লড়াই করতে পারে না বলেই পলাতকের জীবন বেছে নিয়েছে। এই কষ্ট বেছে নিয়েছে।

১৯৭১ দেখেছি২০০১ দেখেছিতারপরেও মনে হয়নি যে আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্যমাতৃভূমির থেকে নিজস্ব জীবনের নিরাপত্তা অনেক বড়। এখন যখন দেখি যারা রাষ্ট্র চালায় বিভিন্ন সময়েতাদের সন্তানরা অধিকাংশই বিদেশী নাগরিক। তারাও অধিকাংশ বিদেশী নাগরিক। অথচ তারা সংখ্যাগুরু ধর্মালম্বী। তখন বুঝতে পারিএই মানুষেরা আসলে রাষ্ট্রক্ষমতাকে কী কাজে লাগায় তা আমরা জানি না। এমনকি তারা যে তাদের নিজস্ব নিরাপত্তা আগেই নিশ্চিত করে এসব কাজে আসেতাও আমাদের মতো মানুষরা বুঝি না। বরং এদের মতো এত সুবিধা ও রাজকীয় পথে না হলেও চুপিসারে যে হিন্দুরা ২০০১-এর পর থেকে মাইগ্রেশন করেছেকেউ কেউ বলে ১৯৯২ থেকে একটা ঢেউ গেছে। এরা মনে হয় আমাদের মতো মানুষদের থেকে অনেক বেশি বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে।

যেমন এই যে এ কথা লিখছিতারপরেও কিন্তু নিজের বিশ্বাসটি ভিন্ন স্থানেসে বিশ্বাস মৃত্যু হোক আর যাই হোক তাহলে মাতৃভূমি ছাড়বো কেনএটা আমার দেশ। রাষ্ট্রের কিছু স্বার্থপর ও লোভী মানুষ আমাকে সংখ্যালঘু করেছে। কিন্তু আমার বন্ধু-বান্ধবযাদের ঘিরে আমি বেড়ে উঠেছিযাদের অনেকে আমার বড় ভাই ও পিতৃব্যর মতোতাদের ভিতর তো কখনও সংখ্যালঘু ও সংখ্যাগুরু এটা দেখেনি। নিজের মনেও তো এটা হয় না। আবার কখনও কখনও মনে হয়সাধারণ মানুষের জীবন তো আমি বুঝি নাতাদের নিরাপত্তাহীনতা বুঝি না।

যেমন মাত্র সপ্তাহ দুয়েক আগে আমার একজন আপনজন আমাকে ফোন করে বললেনঈশ্বর আমাকে রক্ষা করেছেন। এখন আর আমার মারা গেলেও কোন অসুবিধা নেই। কারণকাল মেয়েটিকে ইন্ডিয়ায় পাঠিয়ে দিতে পেরেছি। সেখানে তার একটা বিয়েরও ঠিক হয়েছে। ৫ আগস্টের পর থেকে ওই ছিল আমার সবচেয়ে বড় দুঃশ্চিন্তার কারণ।

তার ফোন রেখে অনেকক্ষণ পড়ার রুমে এসে নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকি। আসলে কে বেশি বাস্তব! ওই যে বৈধব্য জীবনে মানুষটি একাই সিদ্ধান্ত নিয়ে তার মেয়েকে ৫ আগস্টের পর ইন্ডিয়ায় পাঠিয়ে দিতে পেরেছেন তিনি নাকি আমি। তখন মনে হলোআসলে ছোটবেলা থেকে রামমোহনরবীন্দ্রনাথ আর ক্ষীতিমোহন সেনের পরে আমাকে বেশি আচ্ছন্ন করেছেলালন ও তার উত্তরসূরীরাআর সব থেকে বেশি আচ্ছন্ন করেছে কাজী আব্দুল ওদুদ ও সৈয়দ মুজতবা আলী। কাজী আব্দুল ওদুদ ও সৈয়দ মুজতবা আলী ব্রিটিশ চলে যাওয়ার পরে আর কোন মাতৃভূমি পাননি। নিরাপত্তাও পাননি। অন্যদিকে লালনও কোন ঈশ্বর নির্ভর ধর্মের কাছে আশ্রয় পানি।

তাহলে আসলে এই দুই কোটি মানুষের জন্যেই কী প্রয়োজন আগেতাদের মাতৃভূমি না তাদের নিরাপত্তাযে নারী শিক্ষিকাকে বস্ত্রহীনা করে রাস্তায় ঘোরানো হয়েছেসে তো কারো মা। আর সেই মা জন্মভূমি ও স্বর্গের থেকেও বড়। আর মা যেখানে বস্ত্রহীনা হয়সেখানে মায়ের নিরাপত্তা বড় নাকি জন্মভূমি বড়?

রাষ্ট্রচিন্তাজন্মভূমির চিন্তা যাদেরকে আবেগে আচ্ছন্ন করে রাখেতারা কি বাস্তবে মানুষের নিরাপত্তার চিন্তা করতে ভুল করেযেমন ১৯৭১ সালে নদীয়ার ডিসি ছিলেন যে ভদ্রলোকযিনি মেহেরপুরে মুজিবনগর সরকারের শপথ অনুষ্ঠান শুধু নয়তাজউদ্দিন আহমদ ও তার সঙ্গী ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলামকে বিএসএফ-এর মাধ্যমে ভারতে নেওয়ার ব্যবস্থাসহ সব কিছুরই দায়িত্ব পালন করেছিলেনওই ভদ্রলোকের সঙ্গে ২০১৭ সালে দীর্ঘক্ষণ আলাপ হয়। তিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেই চাকরি হারিয়েছিলেন। তিনি চাকরি হারিয়েছিলেন মূলত ভারতের সিভিল সার্ভিস রুল ভাঙার কারণে।

কারণভারতের সিভিল সার্ভিস রুল অনুযায়ী কোন সরকারি কর্মকর্তা কোন রাজনৈতিক মতামত দিতে পারেন না। কিন্তু তিনি সেদিন শুধু রাজনৈতিক মতামত দেননিএকজন ডিসি হয়েও তিনি সরাসরি ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে চিঠি লিখেছিলেন। তার চিঠির সারমর্ম ছিলশরনার্থী হিসেবে যারা ভারতে আসছেতাদের নিরানব্বই ভাগই হিন্দু। ভারত অবশ্য তাদেরকে হিন্দু না বলে পাকিস্তানের নাগরিক বলছে বিশ্ববাসীর কাছে। কিন্তু বাস্তবতা হলোপূর্বপাকিস্তানে যা ঘটছে তাতে সবচেয়ে বেশি নিরাপত্তাহীনতায় হিন্দুরা। আর তাদের বেশিভাগ নির্যাতিত হয়ে আসছে পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু মুসলিমদের দ্বারাপাকিস্তানের সেনাদের দ্বারা নয়। তাই বাংলাদেশ হলেও এই হিন্দুরা নিরাপত্তা পাবে না। বাংলাদেশ দ্রুতই পূর্ব পাকিস্তানের রূপ নেবে। তাই ভারতের উচিত হবে বাংলাদেশ স্বাধীন করে দেবার জন্য পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে নিজস্ব সম্পদ নষ্ট না করা। বরং পশ্চিম পাকিস্তান যা যাচ্ছে সে পথে হাঁটাঅর্থাৎ ভারতের সীমান্তবর্তী যে কয়েকটি জেলা পশ্চিম পাকিস্তান ছেড়ে দিতে চায়সেটা নিয়ে সেখানে হিন্দুদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা। এই ছিল মূলত তার চিঠির সারমর্ম।

এই চিঠি ইন্দিরা গান্ধীর কাছে পৌঁছানো মাত্রই তিনি তাকে চাকরিচ্যুতি করার নির্দেশ দেন। সে দেশের বিধি মতো তাকে দ্রুতই চাকরিচ্যুত করা হয়।

সেদিন তার সঙ্গে অনেক রাত অবধি আলোচনা করে হোটেলে ফিরেগভীর রাতে জানালা দিয়ে তাকিয়ে ১৯৭১ সালের শরণার্থী যে শিবিরগুলোয় আমার নিত্য পা ফেলা ছিলসেগুলোই দেখছিলাম। কারণ এই হোটেল ম্যারিয়ট এখন যেখানেএর চারপাশে তখন জলে কাঁদায় তাবুতেপাইপের মধ্যে বাস করতো শরনার্থীরা। আর তার ভেতর খালি পায়ে ছিল আমাদের নিত্য চলাচল।

তখন স্মৃতিতে জেগে ওঠে এর কাছাকাছিই ইন্দিরা গান্ধী এসেছিলেন। আর ইন্দিরা গান্ধীর সেই মুখসেই শাদা শাড়ীপাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বিজয় উল্লাস মনে পড়তেই মনের মধ্যে ক্ষণিকের জন্য হলেও একটা দ্বন্দ্ব ওঠেনি। কি বড়নিরাপত্তা না মাতৃভূমিপরে মনে হয়েছিলইন্দিরা গান্ধী যতটা ভবিষ্যত দেখতে পানঅতটা ভবিষ্যত তো একজন ডিসির পক্ষে দেখা সম্ভব নয়।

কিন্তু আজ যখন দুই কোটি হিন্দু মূলত দেশজুড়ে অভয়নগরগঙ্গাচড়া আর কুমিল্লার বস্ত্রহীনা মা ও মুরাদনগরের বস্ত্রহীনা কন্যা মত বাস করছেসেই সময়ে মাঝে মাঝে প্রশ্ন জাগে: আসলে ইন্দিরা গান্ধী থেকে শুরু করে আমাদের মতো ক্ষুদ্র মানুষআমরা যারা রাষ্ট্র ও মাতৃভূমি নিয়ে আচ্ছন্ন থাকিআমরা কি আসলে প্রকৃত অর্থে সমাজের ভালনারেবল গোষ্ঠী বা সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার বিষয়টি ভুলে যাই?

আবার হিসাব মেলাতে পারি নাসংখ্যাগুরুর মধ্যে যারা প্রকৃত অর্থে সব মানুষের একটি দেশএকটি নিজস্ব সংস্কৃতির দেশ নিয়ে কাজ করেনতারা তো বারবারই নিরাপত্তাহীনতায় পড়েন। বরং যাদের চিন্তার ভিতর এসব নিয়ে মোনাফিকি আছেঅন্ধ ধর্মব্যবসা  তাদের মনের ভিতর থাকলেও সেগুলো পোষাকে ঢাকারাই শুধু সব সময় ভালো থাকে। তাই এই প্রগতিশীল ধর্মীয় সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের মানুষ যারাতারা-ও এক ধরনের সংখ্যালঘুআবার এই দুই কোটি হিন্দু যারা ধর্মীয় কারণে সংখ্যালঘুএদের নিরাপত্তার পথ আসলে কোন পথে?

লেখক: সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিকসম্পাদক সারাক্ষণ, The Present World.