তখনও তিনি বঙ্গবন্ধু হননি—শেখ মুজিবুর রহমান। ১ নম্বর আসামী রাষ্ট্রদ্রোহী মামলায়। যে মামলা বেশি পরিচিত আগরতলা মামলা নামে। তাঁর সঙ্গে যেমন বেসামরিক ব্যক্তি আসামী ছিলেন, তেমনি সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসনের ব্যক্তিরাও আসামী ছিলেন।
তাঁরা সকলেই বিখ্যাত ব্যক্তি। দেশ ও জাতির জন্যে ততদিনে তারা অনেক অবদান রেখেছেন শুধু দেশপ্রেম থেকে। সেখানে কোনও বিদেশী ডলার বা পাউন্ড ছিল না।
যেমন রাজনীতিবিদ শেখ মুজিবুর রহমান, সামরিক ব্যক্তিত্ব কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন, সিভিল ব্যুরোক্র্যাট রাহুল কুদ্দুস—এমনই সব বিখ্যাত ব্যক্তিরা।
বিচারের আগেই জেলখানায় মেরে ফেলা হয় সার্জেন্ট জহিরুল হককে। এমনই সেদিন দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদদের এতটাই অবৈধ ক্ষমতা দখলকারী আইয়ুব খানের সঙ্গীরা অবজ্ঞা ও তাদের নামে কুৎসা রটিয়েছিলেন—যাকে শুধু এক কথায় বলা যায় ঘৃণিত কাজ।

তারা এতটাই নিচে নেমে ছিলেন যে কর্নেল মুস্তাফিজ রহমান, যিনি পরবর্তীতে জিয়াউর রহমানের আমলে হোম মিনিস্টার ও বেগম জিয়ার আমলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হন, তিনি একদিন শেখ মুজিবুর রহমানের মতো রাজনীতিবিদকে জিজ্ঞাসাবাদের নামে থাপ্পড় মেরেছিলেন।
শেখ মুজিবুর রহমান, নেলসন ম্যান্ডেলা—যারা দেশের জন্যে, দেশের মানুষের জন্যে তাদের জীবন উৎসর্গ করেন। তারা এর বিপরীতে কী করে তা দুজনের ক্ষেত্রেই প্রমাণ আছে।
নেলসন ম্যান্ডেলা যখন সরকারপ্রধান, সে সময়ে তিনি একদিন তাঁর এক সহকর্মীকে নিয়ে একটি রেস্টুরেন্টে যান। তারপর তিনি ওই সহকর্মীকে নিয়ে একটি বিশেষ টেবিলের দিকে এগিয়ে যান। সেই টেবিলে বসে থাকা মানুষটি ম্যান্ডেলাকে দেখে ঘামতে থাকেন।
ম্যান্ডেলা তাঁর সঙ্গে অতি স্বাভাবিক আচরণ করে তার টেবিলেই খেতে বসেন। এবং তিনি ওই ব্যক্তির জন্যও আরও কিছু খাবার অর্ডার দেন। কিন্তু তীব্র শীতেও মানুষটি ঘামতে থাকেন।
ম্যান্ডেলা সামান্য খাবার গ্রহণ করে তাঁর সহকর্মীকে নিয়ে উঠে পড়েন। ওই লোকটির অস্বস্তি ম্যান্ডেলার সহকর্মীর দৃষ্টি এড়ায়নি। তিনি বাইরে এসে ম্যান্ডেলাকে জিজ্ঞাসা করেন—তিনি কি টেবিলের ওই ব্যক্তিকে আগে থেকে চিনতেন? ম্যান্ডেলা মৃদু স্বরে হ্যাঁ বলে মাথা নাড়েন।
ম্যান্ডেলার সহকর্মী জানতে চান—তাহলে তিনি কেন আপনাকে দেখে অস্বস্তিতে ভুগছিলেন? ম্যান্ডেলা অতি সহজভাবে বলেন, আমি যখন জেলে প্রহার সহ্য করার পরে খুব পিপাসায় কাতর হতাম, তখন পানি চাইলে এই মানুষটি আমার মুখে প্রস্রাব করে দিত। তাই সে যাতে ভবিষ্যতে আর ভয় না পায়, এজন্য তাকে দেখে আমি সেখানে গিয়েছিলাম।
কর্নেল মুস্তাফিজুর রহমানও স্বাধীনতার পরে ফিরে এলে আর চাকরিতে যোগ না করলেও বঙ্গবন্ধু তাকে ডেকে কিছু পুঁজির ব্যবস্থা করে দেন। যা নিয়ে তিনি বাগেরহাটে ব্যবসা করতেন।
ম্যান্ডেলা বঙ্গবন্ধুর থেকে আরও বেশিদিন কারা অন্তরালে ছিলেন। তবে বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসির রজ্জু পরানোর চেষ্টা হয়েছিল দুইবার। শেষের বারের ঘটনা আজও সবার মনে আছে। ১৯৭১-এ ফাঁসির রায় দিয়ে, তার জন্য কবর খুঁড়েও বিশ্ব জনমতের কাছে পরাজিত হয়ে অবৈধ ক্ষমতা দখলকারী ইয়াহিয়াকে ক্ষমতা ছেড়ে যেতে হয়েছিল। আর বঙ্গবন্ধু বিশ্বের ইতিহাসের অন্যতম নায়ক হিসেবে পৃথিবীর প্রায় সব মিডিয়ার শিরোনামে বিজয়ী বীর বেশে নেমে ছিলেন দিল্লি হয়ে বাংলাদেশের মাটিতে।

এ ইতিহাস প্রায় সকলের জানা। কিন্তু আজ অনেকের মনে নেই—বঙ্গবন্ধুসহ আগরতলা মামলায় যাদের রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে বিচার করা হয়েছিল ফাঁসি দেওয়ার জন্য, সেই পাকিস্তানি বিচারক এস এ রহমান কীভাবে নিজের প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন।
তার বাসভবনে যখন বিক্ষুব্ধ জনতা আগুন দিতে যায়, সে সময়ে তিনি টাওয়েল পরে মেথর সেজে যে পথে মেথর মল নিয়ে যায় সেই পথ দিয়ে পালিয়ে যান।
আজকের প্রজন্ম জানে না—সে সময়ে এ ধরনের সুয়ারেজ লাইন ছিল না। ময়লাবাহী গাড়িতে ময়লা নিয়ে যেত প্রতিটি শহরে। আর মেথররা টয়লেটের পেছনের স্লাবের খাদে জমা হওয়া ময়লা তাদের পাত্রে করে ওই গাড়িতে দেওয়ার জন্য নিয়ে যেত। এ কারণে প্রতিটি বাড়িতে মেথরদের ময়লা নেবার একটি পথ থাকত।
ভাগ্যিস তখন সেই পথটা ছিল বলেই বিচারপতি এস এ রহমান মেথর সেজে প্রাণে বাঁচতে পেরেছিলেন। কারণ, এই বাঙাল জাতটার প্রবাদগুলো বড় মারাত্মক—“জনতার মাইর, হিসাবের বাহির।”
সারাক্ষণ রিপোর্ট 

























